বৃহস্পতিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২০

খেটে খাওয়া দিনমজুর


একশো ছত্রিশ কোটির মহান ভারতে
আমি একজন সাধারন খেটে খাওয়া দিনমজুর।
শ্রম বিক্রি করেই জরাজীর্ণ ঘরটিকে
হিমালয়ের প্রাচীর হয়ে শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছি।
আপনারা বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের
হর্তা-কর্তা ভাগ্য-বিধাতা.....
না। আপনাদের সাথে আমার কোনো তুলনাই করছি না।
আপনারা বলতে পারেন, আমি কি দোষ করেছি?
কেন আমাকে? শুধু আমাকে নয়.....
আমার মত লক্ষ লক্ষ খেটে খাওয়া দিনমজুরকে
কেন অন্ধকার মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হল??
আপনারা যেদিন সারা দেশে
একযোগে জনতা কার্ফু ঘোষণা করলেন
সেদিন আমি পরিবার-পরিজন ছেড়ে
পাঁচশ মাইল দূরে রাজধানী শহরের কারখানায়....
সারাটা দিন বন্দি থাকলাম। কোন কাজ নেই ।
কাজ না করলে টাকা নেই!
সংসার- বউ বাচ্চা ছেড়ে এতদুর আসার একমাত্র কারণ ...টাকা।
টাকায় সব।টাকা ছাড়া এক পা চলে না।
তারপর আপনারা সারাদেশের লকডাউন ঘোষণা করলেন
প্রতিটা নাগরিককে ঘরে থাকতে
ঘরের বাহিরে বেরোতে নিষেধ করলেন।
ভালো কথা ।খুব ভালো কথা।
কিন্তু আমি কি দোষ করেছি?
প্রথমে আমার কাজ বন্ধ হল।
তারপর সারাদিনে একবার খাবারটুকুও বন্ধ করা হলো।
দুদিন পর লাথি মেরে কারখানা থেকে
আমার সাথে হাজার হাজার শ্রমিককে বের করে দেওয়া হলো ।
অনাহারে-অর্ধাহারে সেদিন রাজধানীর ঝাঁ চকচকে রাজপথেই
সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত নিজের চোখে দেখলাম।
মশা মাছির কামড় খেতে খেতে নিদ্রাহীন চোখে
ভেসে উঠল জীবনসঙ্গীর অশ্রুসিক্ত মুখ।
স্পষ্ট  মনে পড়ে, বাবা মারা যাওয়ার পর আমি
সংসারের হাল ধরতে দু মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে ছেড়ে
চার কুড়ি বয়স উত্তীর্ণ জননীর মুখে অন্ন তুলে দিতে
আমার এম,এ পাশের বাঁধানো ডিগ্রিটা গলায় ঝুলিয়ে
কাজের সন্ধানে পাড়ি দিয়েছিলাম রাজধানীতে।
না ।আর বেশি কিছু ভাবার সময় পায়নি....
শুরু হল ধুমধাম,ধুমধাম শব্দ।চিৎকার, চেঁচামেচি।
যে যেদিকে পারি পালিয়ে বাঁচি।
আপনারা বলতে পারেন, কি দোষ আমি করেছি?
আমিই কি একশো ছত্রিশ কোটি গণতান্ত্রিক দেশে
মহামারী ভাইরাসকে ডেকে এনেছি?
তবে কোন অপরাধে আমাকে কাজ হারাতে হবে?
কোন অপরাধেই বা পুলিশের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করতে হবে?

মনে আছে, কারখানার ম্যানেজার বাবু বলেছিলেন...
মার্চ মাসের অন্তিমে একসাথে আমাদের বেতন দেবেন।
কিন্তু আপনারা যেদিন জনগণকে ঘরবন্দি করলেন
লকডাউন এর নামে!
সেদিন মার্চ মাসের 25 তারিখ ছিল।
আমাদের কারোরই তখন বেতন হয়নি।
হাতে টাকা নেই !কি খাব? কিভাবে বাড়ি যাবো ?
সারা দেশে লকডাউন।
বাস নেই।  ট্রেন নেই। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
রাত্রির অন্ধকারে পুলিশের নির্যাতনে ভিন্নরাজ্যে
আটকে থাকা আমার মতো শ্রমিকরা দিশাহারা ।
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে শুরু হল আমাদের অন্তহীন পথ চলা।
খাদ্য নেই!  টাকা-কড়ি কিছু নেই!
শেষ সম্বল বলতে একটিমাত্র প্লাস্টিকের জলের বোতল।
আপনারা বলতে পারেন কি-দোষ-ছিল-আমার?
আমি কি দেশকে ভালোবাসি নি ?
আমি কি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে এই দেশকে গড়ে তুলি নি?
আর পাঁচজন ছেলের মতোই লেখাপড়া করে মাধ্যমিক পাস করেছি...
উচ্চ মাধ্যমিক,গ্রাজুয়েশন, মাস্টার ডিগ্রি...
সব পাশ করেছি।
তবুও একটা চাকরি নেই!
সংসার প্রতিপালন করার কাজটুকু রাজ্যে নেই!
নিজের জেলায়,নিজের রাজ্যে কাজ পেলে
কেউ কি পরিবার-পারিজন ....সব ছেড়ে
এতদূর অজানা অচেনা ভিন্ন রাজ্যে  কাজ করতে আসে?
কেউ আসে নি। কেউ আসবে না।
ঘণীয়মান  বিপদের দিনে বাড়িতে ছেড়ে আসা স্ত্রীর অশ্রুসিক্ত আঁখি,
আমার মায়ের মলিন মুখটা শেষ বারের মতো দেখার জন্য
আপনাদের লকডাউন অমান্য করেই....
হেঁটে চলেছি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত
খাওয়া নেই! দাওয়া নেই। নেই বিশ্রাম।
কিন্তু কেন? আপনারা বলতে পারেন,আমি কি দোষ করেছি?
আমরাই তো শরীরের রক্ত জল করে ফসল ফলায়
আপনার খাবার টেবিলে সেই অন্ন পোঁছে দিই,
দেশের বিকাশ-রথ বিবরে টানি...
সেই আমরাই হেঁটে চলেছি এক অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে....
জানি, এই পথে মৃত্যু অনিবার্য! তবুও যদি বাড়ি পৌঁছাতে পারি?
কিন্তু না। এখনও বাড়ি পৌঁছাতে পারি নি।
আমার মতো কয়েক সহস্র লোকের মাঝে
আমিও আজ  স্কুলের চারদেয়ালে কোয়ারান্টাইনে বন্দি।
কিন্তু কার দোষে আমার এই বন্দি দশা??
আপনারা বলতে পারেন, আমি কি দোষ করেছি?

©জামাল আনসারী
03/04/2020