বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

ইন্টারভিউ

ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া আছে।ভোর ৪টা ১০এ।কিন্তু ঘুম কিছুতেই হচ্ছে না। দুই চোখ যেন রক্ষীবাহিনীর মতো জেগে আছে। আর আছে একটু টেনশন টেনশন ভাব।রাত ৮টাই শুনছি একটি বাম রাজনৈতিক পার্টি আবার বাংলা বনধ ডেকেছে। গাড়ি ঘোড়া কিছুই চলবে না।আমার ভাগ্যের কি পরিহাস! আমার ইন্টারভিউ যে দিন, সে দিনেই ধর্মঘট!  ভাবতেই গা কাঁটা দেয়। কি যে হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।প্রচন্ড টেনশনে আছি।সঠিক সময়ে আমি স্কুলে পৌঁছাতে পারব তো?

না,না,আকাশ পাতাল ভেবে আজ আর কাজ নেই।আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে।আগামীকালই ইন্টারভিউ। একটা ভিজে রুমাল দুই চোখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইলাম। কিন্তু কথায় বলে না.."খাও বললে বনের বাঘেও খাই না!" ঘুম আর কিছুতেই আসে না।গন্ডা দুয়েক পরীক্ষা দেওয়ার পর কত সাধনায় এই প্রথম কোন ইন্টারভিউতে ডাক এলো।আর যদি না যেতে পারি......
না,না আমাকে যেন তেন প্রকারে সেখানে পৌঁছাতেই হবে।দেওয়াল ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ১০ পেরিয়ে গেছে। এতো রাত্রে আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুকে ফোন করি। সে জানাল যে,ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।আর ছোট খাটো দুই চার চাকার দুই একটা গাড়ি চলবেই।.....একথা শুনে মনে মনে কিছুটা ভরসা পেলাম।

পরীক্ষার সেন্টার পড়েছে পুরুলিয়া জেলার চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে।এই স্কুলটা আমার পূর্ব পরিচিত। গত বছর পি,এস,সি পরীক্ষার সিট সেখানেই পড়েছিল। পুরুলিয়া ষ্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটারের মতো হবে।সে যায় হোক, আমার তন্দ্রাভাব আসতে না আসতেই ঘড়ির এলার্ম টা বেজে উঠলো।  আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। চারিদিক তখনো ঘোর অন্ধকার।আমাদের বাড়ির লাল মোরগটা আমাকে দেখে সপ্তম সুরে ডাকিতে লাগলো।আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে গড়বেতা-রাঁচি প্যাসেঞ্জার ধরে ইন্টারভিউর উদ্দশ্যে রওনা দিলাম।

পুরুলিয়া ষ্টেশন এ নেমে দেখি,গুটিকতক টোটো আর রিক্সাওয়ালা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
একটি টোটোওয়ালাকে বললাম....
দাদা,চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে যাবেন?
------ হ্যাঁ যাবো।গাড়িতে বসুন!
------- কত ভাড়া দাদা?
-------পঞ্চাশ টাকা লাগবে।
-------এইতো গত বছরেই মাত্র পনেরো টাকা ভাড়াতেই ওই স্কুলে গেছি।আর আপনি চাইছেন পঞ্চাশ টাকা! একেই বলে কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ!

পাশের রিক্সাওয়ালা দাদাটি সব শুনতেছিল।আমি যখন বললাম,পনেরো টাকা হলে যাব।না হলে যাব না।তখন পাশের রিক্সাওয়ালা দাদাটি কাছে এসে আমাকে বলল....
"আসুন বাবু, আমি পনেরো টাকাতেই নিয়ে যাব।"
আমি তার পুরনো ভাঙ্গা রিক্সাতেই ওঠে বসলাম।
দাদাটির বয়েস আনুমানিক ৩০-৩২ বছর হবে।রিক্সাটি ষ্টেশনকে পিছনে ফেলে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে এগিয়ে যেতে লাগল।আমি দাদাটিকে জিগ্যেস করলাম....
দাদা,আপনি পনেরো টাকাতেই রাজি হলেন কেন?
সে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে বলল, জানেন বাবু,এখন যে হারে টোটোর সংখ্যা বাড়ছে সে হারে বডি রিক্সাওয়ালা গুলো মারা যাচ্ছে।এখন নাকি ডিজিট্যাল যুগ।আধুনিক যুগ।
এখন মানুষ আর বডি রিক্সাতে চাপতে চাইছে না।আর বডি রিক্সায় না চাপলে, আমাদের সংসার চলবে কি করে বলুন! বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি সংসারটাকে বাঁচাতে রিক্সা চালাতে শিখি।গত দুই দিন থেকে আমার বাড়ির লোকজন না খেয়ে উপোষ করে আছে বাবু।বাড়িতে একদানাও অন্ন নেই।পনেরো টাকা কেন বাবু,আমি দশ টাকাতেও রাজি হতাম।

রিক্সাওয়ালার দু:খের জীবনযাপনের কথা শুনে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।আমার দুটি চোখ অজান্তে কখন অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছে বুঝতেই পর না।পদ্ম পাতায় জল ফেললে যেমন হয়,তেমনি আমার চোখের অবস্থা।রিক্সাতে আজ  না চাপলে বুঝতেই পারতাম না মানুষ কত কষ্টে দিন কাটায়? ক্যাচ ক্যাচ শব্দে রিক্সা ছুটে চলেছে আর রাস্তার দুই ধারে বড় বড় বিল্ডিং গুলো আমদেরকে স্বাগতম জানিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে রিক্সার তালে তালে দাদাটির  সংসারটিও এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ দাদাটি আমাকে জিগ্যেস করেন...
বাবু,আপনার বুঝি আজ ইন্টারভিউতে ডাক আছে?
-----হ্যাঁ দাদা,ডাক আছে।
-----ভাল ভাবে ইন্টারভিউ দিও।পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করো।
আমার কি যেন মনে হল,জিগ্যেস করে ফেললাম,
----দাদা,আপনি লেখাপড়া করো নি?
-----করেছি বাবু।বাংলায় এম,এ পাশ করেছি।দাদা, জানেন আগামীকাল আমারও ওই স্কুলেই ইন্টারভিউর ডাক আছে।
....একথা শুনে আমি তো থ হয়ে গেলাম।মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যের কি পরিহাস! সারাটা দিন রিক্সায় হাড় ভাঙা খাটুনি। এম,এ পর্যন্ত লেখাপড়া।তারপর আবার আগামী কালই  ইন্টারভিউ আছে।
গল্পের তালে তালে কখন যে চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারি নাই। রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম।দাদাটিকে পঞ্চাশ টাকায় ভাড়া দিতে চাইলাম।কিন্তু সে পনেরো টাকার এক টাকাও বেশি নিল না।ভিড়ের মাঝে হেঁটে চলেছি চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলের পথে।একটা প্রশ্নই মাথায় নদীর স্রোতের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল। আমার ইন্টারভিউ আছে, রিক্সাওয়ালা দাদাটিরও ইন্টারভিউ আছে........



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন