মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

পূজোর উপহার


 

রাগে গজ গজ করতে করতে বিকাশ ঘর থেকে না খেয়ে বেরিয়ে গেল। রাগের বশে ছাতাটাও নিতে সে ভুলে যায়।এখন বর্ষা কাল।সে  ঊর্দ্ধগগনের পানে তাকিয়ে বলে,এখন যদিও আকাশে তেমন মেঘ নেই বটে কিন্তু বর্ষাকালের মেঘ কাউকে বলে কয়ে আসে না। আর যখন আসে তখন অকাতরে বৃষ্টি দান করে চলে যায়। যার দরকার তাকেও দেয়, আর যার দরকার নেই তাকেও দেয়।ধনী গরিব সে মানে না। মেঘের কাছে সবাই সমান।বাড়ি থেকে কয়েক পা হেঁটে সরু গলিতে পৌঁছেই দেখে, তিন চারটি সারমেয় ফেলে দেওয়া এঁটো পাতার অধিকার নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়েছে। পৃথিবীতে মনে হয় কেউ কাউকে বিনা লড়াই- এ এক চুলোও অধিকার ছেড়ে দেয় না। লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। এটা পশুরাও জেনে গেছে।আর পৃথিবীর শ্রেষ্ট প্রাণী মানুষ! হা হা হা !বিকাশ নিজের মনেই হেসে ফেলে। 
রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর খগেন কাকার হোটেল আছে। বিকাশ একবার হোটেলের উনুনে চাপা হাঁড়িটার উড্ডীয়মান বাষ্প রাশির দিকে তাকিয়ে ভাবে, একটু গরম গরম ডাল ভাত খেয়ে নিলে ভালো হয়। অফিসে কোনো ক্যান্টিন নেই। হাতে পরে থাকা শ্বশুরের দেওয়া  ঘড়িটির দিকে সে তাকায়। সকাল ন' টা কুড়ি। অফিস বাস সাড়ে ন টায়। হোটেলে ভাত খেলে অফিস পৌঁছতে দেরি হবে। আর দেরি হলে রক্ষে নেই। অফিসের বস নিয়ম করে দিয়েছে দেরি করে এলে মাইনে কাটা যাবে।তাহলে আজকে দিনটি কি উপবাস করে কাটাতে হবে? 



বাড়িতে খেয়ে এলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!বিকাশ ভাবে,সুতপাকে ওই রকম ভাবে কথাটা বলা তার ঠিক হয় নাই। সুতপা তার বিবাহিতা বৌ। সে কি এমন লাখ টাকার জিনিস চেয়েছিল? যে তাঁকে কড়া কথা শুনিয়ে দিতে হল?আগামী পুজোতে একটি ভালো শাড়ী চেয়েছিল। বেশ এই টুকুই তার চাওয়া।আচ্ছা,সে কি চাইতে পারে নাই? না, তার কিছু চাওয়ার অধিকার নেই? যখন তাকে বিয়ে করেছি,তখন তাঁর সমস্ত দায়িত্ব আমার।আমি না দিলে,সে আর কার কাছে পাবে? তাহলে আজ দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করছি কেন?


বাস স্ট্যান্ড এ ঢুকতেই একটি বাস মাটিতে গড়িয়ে থাকা জলকে বিকাশের গায়ের দিকে ছিটকে দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে, বেরিয়ে গেল। পরিস্কার জামাতে নোংরা জল স্টেম হয়ে যায়। এতে তার মনে গাড়ির ড্রাইভারের প্রতি প্রচন্ড রাগ হল বটে,কিন্তু বাসটি চোখের পলকে স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেল বলে, সেই উত্থিত রাগ মনের মধ্যেই পুষে রাখতে বাধ্য হল।।পেন্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে নোংরা জলের দাগ পরিস্কার করতে ব্যর্থ হয়ে,শেষে ড্রাইভার কে বিড়বিড় করে দুটো গালি গালাজ দিয়ে রাগটি কিছুটা হলেও ক্ষান্ত হল।
মাত্র  দশটি টাকা বাঁচবে বলে সে অটো রিকশায় চাপে না।পায়ে হেঁটে এক কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়। তারপর বাসে চেপে অফিসে যায়।অবশ্য আজ নতুন নয়। প্রতিদিনই এই ভাবেই যায়। 


যে গাড়িতে করে বিকাশ অফিস যায়,সেই গাড়িটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে।গাড়িতে উঠেই দেখে, সব বসার সীট ভর্তি হয়ে গেছে।শুধু মাত্র পিছনের দিকে একটি শীটে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা বসে আছে।
বিকাশ ভদ্রমহিলাকে বৌদি সম্বোধন করে বলে, আপনি জানলা দিকে বসুন।আমি এ দিকে বসছি।
ভদ্র মহিলাটি রুদ্র স্বরে বলে, আমি এখানেই বেশ আছি। আপনি বরং জানলার ধারে গিয়ে বসুন।
বিকাশ একটু অবাক হয়ে ভাবল, জানলার দিকে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়? কিন্তু ভদ্র মহিলা বসছে না কেন? নিশ্চিতরূপে কোনো কারণ আছে। সে কৌতুক করে বলে, কেন বৌদি, জানলার ধারে কোনো বাঘ ভালুক আছে নাকি?
ভদ্র মহিলাটি বিকাশের কথায় রেগে গিয়ে চড়া গলায় বলে, বলছি তো জানলা ধারে বসব না। আপনি বাংলা বোঝেন ...কি নেই?
ভদ্র মহিলার ধমক খেয়ে অগত্যা বিকাশকে জানলা ধারেই বসতে হয়। অন্যদিন সে বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যায়। আজ আর চোখে ঘুম আসছে না। সে ভাবে, সুতপা এখন কি করছে? সেও কি রাগ করে না খেয়ে বসে আছে? কিছুদিন আগে একবার রাগ করে সে তিনদিন খায় নি। তারপর বিকাশ বহু কষ্টে তার রাগ ভাঙ্গিয়েছিল।সুতপা বিকাশকে খুব ভালোবাসে। আদর যত্নে স্বামী সেবায় তার কোন ত্রুটি নেই।তবুও মাঝে মাঝে দু জনের একটু আধটু কথা কাটাকাটি হয়। আর বলতে গেলে কার সংসারে তা হয় না। কারো কম কারো বেশি।
বিকাশ অফিস পৌঁছে গেটের কাছে থমকে দাঁড়ায়। সকাল থেকে একটাও সিকারেট খাওয়া হয় নি। জামার পকেট থেকে একটা সিকারেট রের করে তাড়াতাড়ি ধরায়। অফিসে ধুমপানে নিষেধাজ্ঞা আছে। বার পাঁচেক টান মেরে সিকারেট-টি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সিকারেটের দিকে তাকিয়ে বলে, মানুষের রাগ টাও যদি ঐ সিকারেট এর মতো পুড়ে শেষ হয়ে যেত। তাহলে সুতপার সাথে তার কোনো দিনই মনোমালিন্য হত না। 


অফিস করে বিকাশ বাড়ি ফেরার বাস ধরে। আজ আর সিটের জন্য ঝগড়া করতে হয় না ।বাসে উঠেই সে সীট পায়। সারাদিন খাওয়া নেই ।দাওয়া নেই ।শরীরটা বড়ই ক্লান্ত মনে হয়। বাসের সীটে কান্ত শরীরটা সে এলিয়ে দেয়। একটু পরেই সামনের সীট থেকে পরিচিত গলার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে, "বিকাশ তুমি ভুল করছ! তুমি মানুষ, তোমার স্ত্রীও মানুষ। এখানে কেউ বড় কেউ ছোট নয়। ভালোবাসা পেতে হলে ভালবাসা দিতেও হয়। এক পক্ষের ভালোবাসা কখনও চিরস্থায়ী হয় না। সংসার সুখের হয় না।"
কন্ঠস্বর শুনে,বিকাশ সামনের সিটের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু কই? পরিচিত তো কেই নেই!  সামনের দুটো সিটে বসা ভদ্রলোক গুলি ঘুমাচ্ছে। বিকাশের সারা শরীর বিদ্যুতের চমক খেলে গেল। তাহলে কে তাকে এতক্ষন এই কথাগুলি বলল?
সে কি স্বপ্ন দেখছিল? যাই হোক কথা গুলো মন্দ নয়।বাস দাঁড়ালে সে মাঝ পথেই নেমে যায়। তারপর একটি ভালো শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে যায়।

বাড়িতে ঢুকেই দেখে, তার স্ত্রী সুতপার দুই চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। বিকাশের বুঝতে আর বাকি রইল না।সারা দিন কান্না কাটি করে এই অবস্থা হয়েছে।নিজের কৃতকর্মের জন্য তাঁকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।বিকাশ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনোদিন স্ত্রীকে বিনা দোষে কষ্ট দেবে না।খাটের উপর বসেই সুতপাকে ডাক দেয়। সুতপা কাছে আসতেই একটু হেসে, মিষ্টি গলায় বলে, দেখো তো তোমার পছন্দ হয়েছে কি না? বলেই শাড়িটি বাড়িয়ে দেয় স্ত্রীর দিকে।

সুতপা শাড়িটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে কিছু না বললেও তার লালচে অশ্রুসিক্ত চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।রাত্রি হলেও টিউবের আলোয় বিকাশ স্পষ্ট দেখতে পায়।
বিকাশ তাঁর স্ত্রীর চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে, বুকের কাছে টেনে, জড়িয়ে বলে, সুতপা এ শাড়ি তোমার পূজোর উপহার।
17/09/2019


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন