মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

লালগড়ের আন্দোলন



গভীর অরণ্যে যখন কোনো কারনে আগুন লাগে,অগ্নির লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে, আর সেই অগ্নি যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে,তাহলে এমন একটা সময় আসে, যখন অগ্নি যাকেই কাছে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। ভয়ে পশু পাখিরাও যে যেদিকে পারে পালিয়ে বাঁচে, আর যারা পালাতে পারেনা তারা অগ্নি দেবতার পায়ে নতি স্বীকার করে,অগ্নিতেই মিলিয়ে যায়।

মাওবাদী আন্দোলনের সময় লালগড়ের মানুষের সেই অবস্থায় হয়েছিল।যারা পেরেছিল লালগড় ছেড়ে পালিয়ে ছিল।আর যারা পালাতে পারে নি। তারা একদিকে মাওবাদী দের কড়া  হুকুম আর অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে অত্যাচারিত, নির্যাতিত,লাঞ্ছিত হতে হতে কোনো ক্রমে বেঁচে ছিল।সেই বাঁচাকে আর যাই হোক মানুষের মতো বাঁচা বলে না।সেনা বাহিনীর ভয়ে কোন পুরুষ মানুষ বাড়ির বাইরে পা রাখার সাহস পেত না। মেয়েরা তো আরো ভয়ে ভয়ে প্রতিটা দিন আর রাত কাটাত।.. সে কথা বলতে বলতে লালগড়ের আদিবাসী গ্রামের প্রায় নব্বই বছর উত্তীর্ন গোপাল হেমব্রম এক সময় কেঁদেই ফেলে।বুড়ো মানুষের সেই কান্না, শিশুর কান্নাকেও হার মানায়।


কান্না দেখে লালগড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে আসা হারুন আনসারী প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়ে। একটা মানুষকে হাসতে বললে হাসতে পারে বটে,কিন্তু কাঁদতে বলতে কেউই কাঁদে না।  হাসা যত সহজ কাঁদা ততই কঠিন কাজ।এ কথা মনে হয় কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, মানুষ খুব দুঃখ না পেলে  কখনোই কাঁদে না। কিছু কিছু অতীত স্মৃতি আমাদের মনোরাজ্যে উদয় হলে, আমরা কখনো হাসি আবার কখনও কেঁদে ফেলি। বিশেষ করে সেই স্মৃতি যদি বিষদঘন হয়,তবে আমাদের দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে বৃষ্টিপাতের মতোই অঝোরে ঝরতে থাকে।
টিনের চালা ঘরে তক্তপোষ এর উপর বসে থাকা,বুড়ো মানুষটিকে দাদু সম্বোধন করে, হারুন এই অসময়ে কান্নার কারন জানতে চাই।


গোপাল হেমব্রম বাঁধ ভাঙা কান্নার বেগ কোন রকমে দমন করে, একটু ইতস্ততঃ করে বলে, শুন তাহলে, বলি। 
সে সব ঘটনা বহু পুরোনো। তা আজ থেকে আট- নয় বছর আগেকার দিনের কথা। দিনটা ঠিক মনে পড়ছে না। তবুও বলছি। সেই সময় একটাই রাজনৈতিক পার্টি ছিল।কাস্তে -হাতুড়ি -তারা। ওরা বলত আমাদের পার্টি গরিবের পার্টি। তাই গ্রামের সবাই এমনকি আমিও সেই কাস্তে হাতুড়ি তারার পার্টিই করতাম। গ্রামের সবাই গরিব তাই গরিবের পার্টি টাকে খুব ভালবেসে ছিলাম। আর সেই ভালোবাসায় আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।

একদিন মাওবাদীরা গ্রামে এসে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে  লেখা পোস্টার দিয়ে জানিয়ে দিয়ে গেল,আগামীকাল রাত্রে গ্রামের স্কুলে সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। না হলে তার পরিণাম খুব করুন হবে। ভয়ে ভয়ে গ্রামের প্রায় সবাই সেই রাত্রে স্কুলে উপস্থিত হয়েছি। মাওবাদী নেতা , নামটা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না।তাই বলতে পারছি না। নেতাটি  গ্রামের সবাইকে গরিবের পার্টি ছাড়তে অনুরোধ করে যা বলেছিল,তার সারমর্ম হল,....কাস্তে-হাতুড়ি-তারার পার্টি এখন আর গরিবের পার্টি নয়। তারা পুঁজিপতি, শিল্পপতি, টাটা,বিড়লা, আম্বানিদের দালাল। গরিবের সরকার আমাদের বন জঙ্গল জমি কেড়ে নিতে চাই।  আমাদের বিতাড়িত করে, সেই জমি জলের দরে গরিবের রক্ত চুষে যারা আজ বড়লোক হয়েছে,সেই টাটা, বিড়লা কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে চাই। আমাদের সংগ্রাম সেই সব মানুষদের সাথে যারা গরিবকে শোষণ করে, বা শোষণ করতে সাহায্য করে। আমাদের সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধে যারা গরিবকে ঠকিয়ে, ভুল বুঝিয়ে দিনের পর দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে।  তাই সকলেই আমাদের মাওবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করো। 
....না। আমি সমর্থন করতে পারি নাই। প্রকাশ্যেই মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,যতদিন বাঁচব গরিবের পার্টি করব।রাগে,ক্ষোভে, দুঃখে,গোপাল হেমব্রম দাঁত কিড়মিড় করতে করতে খুব জোরের সাথে কথাগুলো বলে ফেলে।
হারুন এতক্ষন একমনে দাদুর কথা শুনছিল। কিন্তু দাদুর চোখে মুখের হঠাৎ অভিব্যক্তির পরিবর্তন তার মনে ভয়ঙ্কর ঠেকে। সে বুঝতে পারে না, দাদুর ক্ষোভটা কার বিরুদ্ধে? হারুন ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি বলে, তারপর কি হল?
...তারপর মাওবাদীরা আমাকে সেখান থেকে রাতেই তুলে নিয়ে গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
...প্রতিবেশীরা কেউ বাধা দেয় নি।ভয়ে ভয়ে দুরু দুরু বক্ষে হারুন মৃদু সুরে বলে।
...সেখানে হাজার খানেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে এলো না। আমার জানা,চেনা প্রতিবেশীরা কেউ বাধাও দিল নি। তবে বাধা দিয়েছিল আমার ছেলে বিমল।
...বিমল! হারুন অস্ফুট স্বরে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে থেমে যায়।
...হ্যাঁ। বিমল আমার ছেলে। সে বলেছিল, " বাবা যদি ভুল করে থাকে তার বিচার এখানেই হোক।" মাওবাদীরা তার কথায় কোনো কর্ণপাত করে নাই।

                       ***************(2)****************
বিমল হেমব্রম সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চমাধ্যমিক এ বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছে। গ্রামের মধ্যে সেই সবথেকে মেধাবী ছাত্র ।আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যই  খুবই গবির। তারা জঙ্গলের উপরেরই নির্ভরশীল।জঙ্গলের শাল পাতা বাড়িতে এনে সেই পাতায় থালা তৈরি করে ।জঙ্গলের কাঁচা কাঠ কুড়ুল দিয়ে কেটে মহিলারা মাথায় করেই  সাত আট কিলোমিটার পথ তপ্ত রৌদ্রে হলেও খালি পায়ে হেঁটে বাজারে বিক্রি করে আসে। জঙ্গলের কেন্দু পাতা সংগ্রহ করে এবং সেইগুলি  বাজারে বিক্রি করে দুটো টাকার মুখ দেখে। তাছাড়া টাকা উপার্জনের আর কোন পথ নেই। তাই দারিদ্র আদিবাসী পরিবার গুলির নিত্য সঙ্গী। সংসার চালাতে  খুব কষ্ট হলেও বিমলকে পড়াশুনা করতে সর্বদা সাহস জুগিয়ে গেছি। কোনো কোনো দিন হয়তো অনাহারে,অর্ধাহারে কেটেছে বটে,কিন্তু বিমল লেখাপড়া করে চাকুরী পাবে,অনেক টাকা রোজগার করবে ভেবে সেই অনাহারে,অর্ধাহারে কাটানোর দুঃখটা নিমিষেই উধাও হয়ে যেত।....বলেই গোপাল হেমব্রম চুপ করে যায়।

.....হারুন দাদুর কথা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ।তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে  বলে, দাদু তোমাকে যে, মাওবাদীরা তুলে নিয়ে গেল, তারপর কি হল?

....গোপাল হেমব্রম দুই চোখ একটু বন্ধ করে, আবার চোখ খুলে বলে, ..
ও ,হ্যাঁ। সে কথাও বলছি।সেদিন ওই গভীর জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রি অবসান করে নব প্রভাতের স্বাদ নিয়েছি। অমাবস্যার রাত্রি ছিল বলে ঠিক জঙ্গলের কোথায় তাদের আস্থানা তা আমি আজও হাজার মনে করলেও বুঝতে পারি নাই। তবে সেখানে কম করে হলেও  ত্রিশ চল্লিশ জন মাওবাদী উপস্থিত ছিলেন।আমি কারও নিমক খায় নি তাই ভুল বলব না। সেখানে উপস্থিত কেউই আমার সাথে কোন রূপ খারাপ ব্যবহার করে নাই। আমার হাতে বা জঙ্গলে কোনো ঘড়ি ছিল না বলে টাইম টা ঠিক বলতে পারছি না। তবে রাত্রি দশটার কম কিছুতেই হবে না।একজন মধ্যম বয়সের মাওবাদী আমাকে কাছে ডেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, যা আমি আজও ভুলি নাই।
.....হারুন তাড়াতাড়ি উৎসহভরে বলে ,দাদু...কি কথা?বল।বল।

মাওবাদীরা বলেছে, তারা কখনও সাধারন মানুষের ক্ষতি করে না। শিশু ও মহিলার ক্ষতি করে না। তারা সমাজের অন্যায় অচ্যাচার, শোষণ বঞ্চনা নির্মূল করে এক সুন্দর,সাম্য সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে। কখনোই হিংসার আশ্রয় নেয় না। তবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আঘাতের উপযুক্ত জবাব দিতে বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। সেদিন অনেক কথায় শুনিয়েছে, সব কথা আমার আজ আর মনে নেই।
শেষে আমাকে অভয় দিয়ে বলে, আমি যেন তাদের কখনও ভয় না করি। কিছু শুকনো খাবার আমাকে দিয়ে ,ওরাও আমার সঙ্গে খায়। তারপর যখন যে ওই নির্জন গভীর অরণ্যে খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছি, আমার মনে নেই। সকালে গোলা গুলির প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙলে এক মাওবাদী আমার দুই চোখ গামছা দিয়ে ভালো করে বেঁধে,গম্ভীর ভাবে বলে, গামছা খোলার চেষ্টা করবে না। আমার হাত ধরে ধরে এসো।


একবার ভাবলাম আজই আমার শেষ দিন। ভয়ে ভয়ে ঐ ব্যক্তির হাত ধরে গভীর জঙ্গলে ঘন্টা খানেক হাঁটার পর একসময় সে আমার হাতটা হেঁচকা দিয়ে বলে, দাঁড়াও।
আমার গামছা খুলে দিয়ে মাওবাদী ছেলেটি বলে, এরপর বাড়ি যেতে পারবে তো?
...স্বস্তির নিঃশাস ফেলে,তাড়াতাড়ি বলি,পারব।
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসি।.......
ইতিমধ্যেই গোপাল হেমব্রমের স্ত্রী  চা খাবার নিয়ে এলে গল্পে একটু ছেদ পড়ে।গল্পটা শুনতে হারুনের ভালোই লাগছে,তাই চায়ের কাপটা হাতে ধরেই হারুন বলে, দাদু তারপর কি হল? 
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে  বলে, আগে গরম গরম  চা টা তৃপ্তি ভরে খাওয়া হোক তারপর বলছি। 


                              ************(3)************
চা খাওয়া পর্ব সমাপ্ত হলে স্ত্রীকে ডেকে চায়ের কাপ দুটি তাঁর হাতে দিয়ে বিদেয় করে বলে,বাড়ি এসে শুনছি, এলাকায় মাওবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে,আধা সামরিক বাহিনী এসে গ্রামে খুব তান্ডব চালিয়েছে। যদিও এর আগেও বিনা দোষে সি আর পি এফ জওয়ানরা গ্রামবাসীদের মারধর করেছে। তবে দিন কয়েক আগে শালবনি দিকে মাওবাদীরা ল্যান্ড মাইন ফাটালে কোন এক বড় নেতা নাকি অল্পের জন্য জীবনে বেঁচে যায়।

তারপর থেকেই  নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অচ্যাচার নেমে আসে। কিন্তু সহ্যের একটা সীমা আছে, রাবারকে ধরে যদি ক্রমাগত টানা হয় তাহলে একটা সময়ে সেই রাবার ছিঁড়ে যায়। অত্যাচারিত মানুষও অচ্যাচার সহ্য করতে করতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন ঘুরে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ করে। লালগড়ের সাধারণ মানুষও প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছে।নারীদের যতই অবলা,বলা হয় না কেন, তারা যদি একবার হাতে অস্ত্র ধরে,পৃথিবীও কেঁপে ওঠে। নারীরা ঘরে বসে না থেকে পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে প্ৰতিবাদ করে। আর তখনই রাজ্যের শাসকদল,এমনকি সরকার পর্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। খবর আসে, ছোটপেলিয়া গ্রামে প্রতিবাদী মানুষের মিছিলের উপর পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। নির্যাতনের হাত থেকে মেয়েরাও ছাড় পায় নি। সেনা বাহিনী মহিলাদের উপর কি রকম শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তাঁর জলন্ত প্রমান সীতামনি মুর্মু ।পুলিশ তাঁকে চুলের মুঠি ধরে আছড়ে মারে। বন্দুকের বাট দিয়ে গুঁতিয়ে  সীতা মনির একটা চোখ কানা করে দেয়। 
... হারুন ।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তারপর?

তারপর এই পুলিশের  অন্যায়, অচ্যাচার, দমন পীড়ন দেখে লালগড়ে গড়ে ওঠে "পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কমিটি" । এই কমিটি লালগড় আন্দোলনের পুরোভাগে নেতৃত্ব দেয়। টেলিভিশন এর কল্যানে লালগড়ের আন্দোলন সারা পৃথিবী দেখে। রাস্তা কেটে, পথে গাছের গুঁড়ি ফেলে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট। আমার ছেলে বিমল হেমব্রমও সেই আন্দোলনে যোগদান করে।

জনসাধারণের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে সরকারের চেষ্টায় লালগড়,কাঁটা পাহাড়ি,ধরমপুর, কলাইমুড়ি, রামগড় অঞ্চলে পুলিশের বিশাল ক্যাম্প বসে। তাছাড়া সকরারী হাসপাতাল,স্কুল,অফিসের ঘর দখল করেও পুলিশ ক্যাম্প করে।চারদিকে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করে। ভয়ে ভয়ে লালগড়, ধমপুর,বইতা, ঠাকুরপাড়া, চাঁদাবিলা,পূর্ণপানি, ভোলাগাড়া  বীরকাড়, আমলিয়া ,আজনাসুলি, আরো কত গ্রামের মানুষ দিন কাটায়। কখন যে কি হয় সেই অজানা আতঙ্কে সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়।রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ সাধারণ মানুষকে ধরে মারধর করে। ঘরে বন্দি থাকার ফলে  বাজার হাট করাও বন্ধ হয়।ওদিকে মাওবাদীরা শাল গাছের গুড়িতে পোস্টের সেঁটে জানান দেয়, বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধন কর্মসূচি পালন করতে হবে। 
হারুন আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তারপর? তারপর?

তারপর, একদিন পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কিমিটি হাজার হাজার মানুষের মিছিল করে, থানায় তেরো দফা দাবি পেশ করে। 
হারুন কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞাসা করে,...দাদু ! সেই দাবি গুলি কি ছিল?
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে, তারপর বলে, সেই দাবি গুলি আজ সব আমার মনে নেই। তাছাড়া আমি কেন,কেউই মনে হয় আজ আর বলতে পারবে না। তবে কয়েকটি দাবি আজও মনে আছে।যা শুনলে তুমিও হাসবে! এক, দুই করে বলছি....
এক)প্রথম দাবিটি থানার এস পি- কে কানে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। আর বলতে হবে আজ থেকে জনসাধারণ ও মহিলাদের বিশেষ করে গ্রেপ্তার ও অচ্যাচার বন্ধ করছি।
দুই) যে পুলিশ কর্মীরা ছোটপেলিয়ে গ্রামে মহিলাদের উপর  শারীরিক অত্যাচার করে,এমনকি মহিলার চোখ পর্যন্ত মেরে কানা করে দিয়েছে, তাদের  দলিতপুর চক থেকে ছোটপেলিয়া গ্রাম পর্যন্ত নাকখত দিতে হবে।
তিন) এলাকার জনসাধারনকে যখন তখন মাঠে, ঘটে,বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা বন্ধ করতে হবে।
তাছাড়াও আরো কিছু দাবি ছিল। যে দাবিগুলো এলাকার সাধরন মানুষের সাথে জড়িত ছিল। 


হারুন একনাগাড়ে শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সে ভাবে এ গল্পের মনে হয় শেষ নেই।তাই একটু অধর্য্য হয়ে বলে,দাদু! গল্পটা আর এতটা আছে?
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে তাড়াতাড়ি বলে, এর একটু।যখন এতক্ষন শুনতে পারলে তখন শেষটা শুনেই যাও। 

 অফিস টাইমে শিয়ালদা রেলস্টেশনে কোনো লোকাল প্যাসেঞ্জার থামলে নিত্যযাত্রীদের মধ্যে গাড়িতে উঠার জন্য যেমন হুড়োহুড়ি পড়ে, তারপর চলন্ত গাড়ির মধ্যে প্যাসেঞ্জাররা ঠেলা ঠেলি, মারামারি করতে লাগে, তেমনি লালগড়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন চূড়ান্ত উদ্যমে চলছে তখন পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কমিটিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে। কিছু স্বার্থান্বেষী, সুযোগসন্ধানী মানুষ সেই কমিটিতে ঢুকে লালগড়ের আন্দোলনের বারোটা বাজিয়ে দেয়।জানো,হারুন,....কিছু বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর সব জায়গাতেই আছে। তাঁদেরই সহযোগিতায় সাংবাদিক ছদ্মবেশে পুলিশ, লালগড় আন্দোলনের,তথা পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির লড়াকু সর্বজনপ্রিয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে।সেই নেতার নামটা নিশ্চয় আজ আর নতুন করে বলে দিতে হবে না । আজ সারা বাংলা কেন, সারা ভারতের মানুষ জেনে গেছে। তারপর লালগড়ের জনগনের সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষন চুপ থেকে গোপাল হেমব্রম আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। 
হারুন কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। আবার কি হল?  সান্ত্বনা দিয়ে বলে, দাদু। চুপ করো।....
...হারুনকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দাদু বলে, চুপ করো, বললেই আমি কি চুপ থাকতে পারি? লালগড়ের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে,তখনই একদিন গভীর রাতে পাঁচ সাত জনের একটি দল কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, আমার একমাত্র ছেলে বিমলকে  তুলে নিয়ে গেল।
...তারপর বিমলের কি হল? হারুন তাড়াতাড়ি বলে।
বৃদ্ধ গোপাল হেমব্রম চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,তারপর।...আজ প্রায় নয় বছর হল। আমার বিমল এখনো পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসেনি।প্রশাসনের দরজায় দরজায় বহু বছর ঘুরেছি। কিন্তু আমার ছেলে বিমল হেমব্রম এর কোন সন্ধান কেউ দিতে পারে নাই।আজও আমি তাঁরই আশায় সকাল সন্ধ্যা পথ চেয়ে বসে আছি.......

হারুন সাহস করে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না ,আর গোপাল হেমব্রম মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে।পাখির কিচিরমিচির কলরব কানে প্রবেশ করে জানিয়ে দেয় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।


            
(বি:দ্র- গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক)
15/09/2019



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন