বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

সোনালীর বিয়ে

মহা ধুমধামের সহিত, সমস্ত ঘর- বাড়ি- উঠোন, পাড়ার রাস্তা, আলোয় আলোকিত করে,কোন রকম ঝুট- ঝামেলা ছাড়াই সোনালীর বিয়েটা ভালই ভালোই মিটে গেল। সোনালী এমনি ধুমধাম করেই তো একদিন বিয়ে করতে চেয়েছিল !  ইচ্ছে হলেই তো আর সকল সেই ইচ্ছে পূরণ হয় না। তবে সোনালীর এই ধুমধাম করে বিয়ে করার ইচ্ছাটা এতদিনে পূর্ণ হল । সোনালীর বাবা একজন সামান্য ব্যাংক কর্মচারী। তাই মাস মাইনের বেতনটাও সামান্যই। তবুও মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি বিয়েতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। সোনালী-ই তার বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। বাবা-মা বিস্তর দেখাশোনা করে সুপাত্রে তাদর আদরের কন্যাকে সমর্পণ করে ।পাত্রটিও মন্দ নয়। দেখতে শুনতে ভাল। সরকারী না হলেও বেসরকারী চাকুরে। তাতে কি! 
ভালো অঙ্কের মাস মাইনে তো আছে। তাছাড়া পাত্রের বাবার সাথে সোনালীর বাবার কিছুটা পরিচয় আগের থেকেই গড়ে উঠে।
তারা দুজনেই সাদাসিদে ভদ্রলোক। দুজনেই ব্যাংক কর্মচারী। তারপর দুজনের মেদিনীপুরেই তাদের চাকুরীস্থল ।তাই ভরসা করেই তিনি পুরনো দিনের বন্ধুর একমাত্র ছেলে অভিজিৎ এর হাতে নিজের আদরের একমাত্র কন্যা সোনালীকে তুলে দেই। যদিও এ বিয়েতে সোনালীর মতামত নেওয়া হয় নি ।সে বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিল না। কিন্তু মেয়ের মতামতে কিবা আসে যায়! মেয়ে মানুষ! পরিবারের কাছে শেষ পর্যন্ত সোনালী নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
যাইহোক বিয়ের পরেই সোনালী বরের সাথে কলকাতার ফ্লেটে চলে যায়। সোনালী গ্রাম্য মেয়ে। শহরের আদব-কায়দা রীতি-নীতি সবকিছু ঠিকমতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি। কলকাতার মতো ব্যস্ত রাস্তায় সোনালী কোনদিন হাঁটে নি। বিয়ের আগে কোনদিন ফ্লাটে থাকেও নি।তাই বলে কি সে ঘর সংসার ছেড়ে পালিয়ে আসবে? না ,তা বোধ হয় আর কোনোদিনই সোনালীর পক্ষে সম্ভব হবে না।

নীল আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ কে বাড়ির খাঁচায় বন্দী করলে পাখির যে অবস্থা হয়, সোনালী অবস্থাটা অনেকটা সে রকম। গ্রামে তার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবিদের বাড়ি আনাগোনা। অফুরন্ত সুযোগ। কলকাতায় এখনো তার কোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয়-স্বজন গড়ে ওঠেনি। যদিও সোনালীর বর অভিজিৎ মন্ডল খুব ভালো মানুষ। অফিস টাইম বাদে বাকি সময়টুকু সোনালীর সাথেই কাটান। তবুও সোনালীর মন পড়ে থাকে সেই গ্রামেই।হবেই না কেন! গ্রামের সাথে তার নাড়ির যোগ । এটা তো আর কেউ-ই অস্বীকার করতে পারবে না। তাছাড়া সাদা কাগজে দাগ লাগলে যেমন সহজে যায় না, তেমনি প্রথম প্রেমও সাদা কাগজের দাগের মতোই মন থেকে সহজেই মুছে ফেলা যায় না।

ঠাকুর যেমন সমস্ত মনোযোগ দিয়ে মাটির মূর্তি গড়ে, তেমনি পৃথিবীর সমস্ত রূপ তিল তিল করে আহরন করে স্রষ্টা সোনালীকে অপরূপ সুন্দরী করে গড়ে তুলেছে। দুধে আলতা রাঙা গায়ের বর্ন। দেখতে রূপকথার পরীর মতো।বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে, বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন " চর্যাপদ" এ কোনো লেখকের লেখা থেকে জানা যায়, 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।" তেমনি সোনালী অতি সুন্দরী মেয়ে হওয়ার জন্য, পাড়ার ছেলেদের লুব্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে চলা খুব কঠিন। সবাই তাকে কাছে পেতে চাই। ভালোবাসতে চাই। আপন করে নিতে চাই। প্রেম করতে চাই। বন্য হরিণকে ধরতে সবাই যদি ফাঁদ পেতে বসে থাকে, থাকলে, হরিণ যতই চালাক, চতুর হোক না কেন, সেই হরিণ কারো না কারো পাতা ফাঁদে একদিন না একদিন পড়বেই। 
সোনালি ওই ভাবেই একদিন ধরা পড়েছে বিকাশের হাতে।
বিকাশ সোনালীদের পাড়ার ছেলে। পড়াশোনায় বেশ ভালো। গ্রামের সবাই তাকে চেনে, জানে।
                     *************(2)**************
সোনালী গ্রামের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিনিয়ত ইচড়েপাকা ছেলেদের নানা অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণবাক্য বাণের শিকার হয় । তবুও সাফল্যের সাথে মাধ্যমিক ,উচ্চ মাধ্যমিক রেজাল্ট করে ।গ্রামের নামো পাড়ার রথতলা পেরিয়ে পাশের গলিতে একটু গেলেই কোচিং সেন্টার। সেখানে সাপ্তাহে একদিন কোচিং হয়। কোনদিন সকালবেলা তো কোনদিন বিকালবেলা।সেদিন বিকালবেলা কোচিং যাওয়ার পথে কিছু ছেলে আবারও সোনালীকে অশোভন ইঙ্গিত করে।... সোনালীর কাছে এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয় ।প্রায় দিনই যাতায়াতের পথে তার সাথে ছেলেরা এরকম ব্যবহার করে। তবুও সোনালী তাদের পাত্তা দেয় নি।
কোচিং সেন্টারে পৌঁছে কিছুক্ষণ পরেই আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ঝড় আসে ।ঝড় বৃষ্টি যেভাবে দুরন্ত বেগে এলো , সেভাবেই ঘন্টাখানেক তাণ্ডব চালিয়ে চলেও গেল। সাথে করে নিয়ে গেল ইলেকট্রিক কারেন্টটা । যখন কোচিং ক্লাস ছুটি হলো তখন পথে কালো কুচকুচে অন্ধকার। গাছের ঝরা পাতা পথের মাঝখানে কোথাও কোথাও স্তূপাকারে জমা হয়েছে। জমা হয়ে যাতায়াতে গতিপথ রুদ্ধ করছে।পথে কোন লোকজন নেই। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ।ব্যাঙের ডাক। গা ছমছম পরিবেশ। সোনালী অন্ধকারের বুক চিরে একটু জোর গতিতে পা ফেলছে । কোচিং সেন্টার থেকে সোনালীর বাড়ি বেশি দূরে নয় ।প্রায় এক কিলোমিটার মত হবে। তবুও হেঁটে হেঁটে মিনিট 10-15 মিনিট তো লাগবেই। কিন্তু রাস্তাটা আজ যেন শেষ হচ্ছে না।সাইকেলটি ঠেলে রথতলা পর্যন্ত এসে সোনালী থমকে দাঁড়ায়।
সামনে গোটা চারেক ইছড়ে পাকার দল। তারা মনে হয় ঝড় বৃষ্টির সময় রথতলাতেই ছিল।
হঠাৎ দলের একজন বাঘ যেমন হরিণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেভাবে সোনালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে , লোভাতুর দৃষ্টিতে চোখ পাকিয়ে বলে,...
"আজ শালিকে ছাড়ছি না।"
অপর দুজন সাথে সাথেই সোনালীকে ধরে টানতে টানতে বলে, 
"চল।চল, শালিকে নিয়ে চল।বহুত বাড় বেড়েছে। আজই সব মিটিয়ে দেব।"
টানাটানি করতেই সাইকেলের উপর সোনালী পড়ে যায় । তবুও অসম যুদ্ধে দুষ্কৃতি দের হাত কামড়ে, তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে ওদের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। কিন্তু সে একা আর ওরা চার জন। সোনালি কি করে পেরে উঠবে?সোনালীর মান সম্মান ইজ্জত যখন মাটিটে মিশতে চলেছে সেই দুঃসময়ে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে বিকাশের।সে সোনালীকে শ্লীলতাহানির হাত থেকে রক্ষা করে।

বিকাশ সোনালীর পূর্ব পরিচিত। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিকাশ সোনালীকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেসময় সোনালী তা প্রত্যাখ্যান করে।আর আজ বিকাশেই তাকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করে, ইচড়েপাকাদের মেরে,নাক ফাটিয়ে দেই। বিকাশ,একসময়ের ভালোবাসার পাত্রী সোনালীকে দুহাত ধরে তুলে বিনীত ভাবে বলে...
" চলো। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।"
সোনালী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অফুস্ট স্বরে উত্তর দেয়।
"বিকাশ দা ।আমি একাই যেতে পারবো।তোমাকে আর যেতে হবে না।"

তবুও বিকাশ সে রাতে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেই।সোনালী বিকাশের উপর আগে যতটা ঘৃণা করত, সে দিনের ঘটনার পর ততটাই ভালোবাসতে শুরু করে।সেই দুঃসময়ে বিকাশ না থাকলে সোনালীর যে কি হতো! ...এটা ভাবলেই সোনালীর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে ওঠে ।
গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বৃষ্টির জল মাটিতে পড়লে মাটি যেমন সিক্ত হয়ে ওঠে, তেমনি বিকাশের স্নেহের স্পর্শে সোনালীর হৃদয়ও সিক্ত হয়ে ওঠে। 
সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলের বাউন্ডারির আম গাছের ছায়ায় বসে প্রসাদ খেতে খেতে সোনালী বিকাশকে বলে, 
"তোমার এস এস সির খবর কি?
বিকাশ একটু কাচুমাচু করে বলে,
"টেট পরীক্ষায় পাস করে বসে আছি। সরকার রেজাল্টই দিচ্ছে না ।আশা করি এবারই আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। আর চাকরিতে জয়েন করেই ইয়ে, মানে তোমাকে লাল টুকটুকে বেনারসি পরিয়ে উলুধ্বনি বাজিয়ে আমার ঘরে নিয়ে যাব ।"
সোনালী বিকাশের পিঠে হাত রেখে একটু মিস্টি হেসে হেঁয়ালীর করে বলে, সাত মন ঘি হবেই, না, রাধা নাচেই হবে। আগে জয়েন্ট করো। তারপর......"

             ******************(3)******************

সরস্বতী পূজার পরের দিন বিকাল বেলা রান্না ঘরে, রাতের রুটি করার জন্য আটা মাখাতে মাখাতে সোনালীর মা সোনালির বাবাকে হঠাৎ ই বলে ওঠে ,
"সোনালীর বিয়ের ব্যাপারে কি কিছু ভাবছ! মেয়েটা যে দিনকে দিন তালগাছ হয়ে উঠছে গো।"
সোনালীর বাবা টিভিতে খবর শুনতে শুনতে বিজ্ঞ জনের মতো বলে, "কথাবার্তা চলছে। দেখি কি হয় ? বিয়ে তো দিতেই হবে ।আজ না হোক কাল।"
বাড়িতে বিয়ের কথা বার্তা উঠলে,কোন উপায় না দেখে,  অগত্যা সোনালী তাঁর মাকে চুপি চুপি বলে, 
" মা। আমি বিকাশকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে হলে ওকেই করব।"
সোনালীর মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন বিকাশ রে?
.... "গ্রামের নামো পাড়ার বিকাশ!"সোনালী তাড়াতাড়ি উত্তর দেই।
সোনালীর কথা শুনে তার মা চুপ থাকে। কিছু বলে না।
সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া সমাপ্ত হলে সোনালী বিকাশের সাথে সম্পর্কের সবকিছু কথা মা- বাবাকে খুলে বলে। সমস্ত কথা শোনার পর তারা সোনালীর ভালো লাগা পাত্রের সাথেই বিয়ে দিতে রাজি হয়। সোনালীর কথা মতো ধুম ধাম করে বিয়ের আয়োজন করবে বলে কথা দেয়।এই শুনে সোনালীর আনন্দের আর কোনও সীমা থাকলো না! কিন্তু বাঁধ সাধলো তার মামা। সে যুক্তি দিয়ে বোঝালো,
"বিকাশ ছেলেটি ভালো তাতে কোন সন্দেহ নাই। সমস্যা হলো ছেলে এখনও বেকার ।কোন কাজ নেই। খাওয়াবে কি? পরাবে কি? তাছাড়া আগামী দিনে চাকরি পাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই? বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সোনালীর জীবনটা নষ্ট করো না।"


এর কয়েক দিন পরেই ঘটনার নাটকীয় মোড় পরিবর্তন হয়। এক শুভ লগ্নে বিকাশকে বাদ দিয়েই অভিজিৎ মন্ডলের সাথে সোনালীর বিয়ের পাকা কথা হয়।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন