বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

সেই চিঠিটা

পোস্ট মাস্টারের ডাকে কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিশ্বজিৎ এর। পোস্ট মাস্টারের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে এক ঝলক উপরের নামটা দেখেই তার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুত চমকে গেল। 
বুকের ভিতর একটা মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হতে লাগলো। যে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল আজ থেকে দশ বছর আগেই।
পোস্টমাস্টারের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে, না খুলে দেখেই নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেই। তার স্মৃতিপটে চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই অতি পরিচিত একটা মেয়ের মুখ। যদিও সেসব আজ থেকে এক দশক আগেকার ঘটনা।

বিশ্বজিৎ গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। এতদিন পরে অনামিকা কেন আমাকে চিঠি লিখল?
তাহলে কি তার কোনো বিপদ হয়েছে। 
না, না, তা কখনো হতে পারে না । বিশ্বজিতের মুখ দিয়ে অজান্তেই এই কথাগুলো বেরিয়ে যায়। 
তখনও সন্ধ্যা হয়নি।সোনালী সূর্যটা নীল আকাশের পশ্চিম দিকের কোণে তখনও অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে ।পাখিরা একে একে নিজের বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। ঘরে ফেরার আনন্দে পাখিরা মনের আনন্দে কিচিরমিচির গান ধরেছে। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলির ছবি।

বিশ্বজিৎ তখন রঘুনাথপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।তাঁর বাবা-মার ইচ্ছা অনুযায়ী সে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে ।
এক বৃষ্টিমুখর দিনে কলেজ যাবার সময় অনামিকার সাথে তার প্রথম পরিচয় । অনামিকা তখন রঘুনাথপুর গার্লস স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরতা। যাওয়া-আসার মাঝেই তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। যতদিন যায় তাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় ও মজবুত হয় । বিশ্বজিৎ নিজের অজান্তেই কখন যে অনামিকাকে ভালোবেসে ফেলে,সে নিজেই বুঝতে পারেনা।আবার নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতোই অনামিকাও বিশ্বজিৎ কে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে।

বিশ্বজিৎ একদিন কলেজ যাওয়ার নাম করে অনামিকাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যায়। পাশাপাশি দুজনে বসে সিনেমা দেখে ।হঠাৎ-ই অনামিকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, "তুমি আমাকে আজ কথা দাও। কোনদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো ! যত দুঃখ কষ্ট, বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবে তো? জানো আমার খুব ভয় হয়। যদি..." 
ধুর পাগলী ! বিশ্বজিৎ একটু হেসে অনামিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
"তোমাকে আমি কি কখনো ছেড়ে যেতে পারি।জীবনে যত ঝড় আসুক না কেন, আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে রাখবো। আজ আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে বিয়েই করব না।"

নদীর স্রোতের তালে তালে তাদের জীবন আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলে। 
সেদিন ছিল রবিবার। আকাশে ঘন কালো মেঘ। দূরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে । হঠাৎ অনামিকা বিশ্বজিতের বাড়িতে হাজির। সে সময় বাড়িতে আর কেউ ছিল না ।এমনকি সেদিন বাবা- মাও বাড়িতে ছিল না।

অনামিকার এই অসময়ে আগমনে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। অনামিকা বাচ্চা মেয়ের মতো শুধুই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মুখ দিয়ে কোন কথাই সে বলতে পারছে না । বিশ্বজিৎ পাশে গিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে কিছুটা স্বান্তনা দিলে, অনামিকা কম্পিত ঠোঁটে বললো...
"আজ আমায় ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল । বাবা- মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাই। তুমি এক্ষুনি কিছু একটা ব্যবস্থা করো। না হলে আমাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।"
---এ কথা শুনে বিশ্বজিতের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়ে গেল ।সে চারদিকে ঘন অন্ধকার দেখতে লাগলো। এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে? কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। সামনের মাসেই তার কলেজ ফাইনাল পরীক্ষা । কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশ্বজিতের জীবনের সমস্ত হিসেব -নিকেশ ওলটপালট হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই এক শুভ দিন দেখে অনামিকার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর তার মন না চাইলেও সে শ্বশুর বাড়ি যেতে বাধ্য হয়। বিশ্বজিতের অশ্রুতে সেদিন ধরণী সিক্ত হয়ে উঠেছিল। সে চিৎকার করে সেদিন বারবার ভগবান ডেকেছে।
"ওগো ভগবান! তুমি কি আছ?" 
ভগবান কিন্তু সেদিন বিশ্বজিতের কাতর ডাকে কোন সাড়া দেননি।কোনো উপায় না দেখে বিশ্বজিৎ সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয়, জীবনে সে আর কাউকে বিয়ে করবে না। অনামিকার স্মৃতিটুকু বুকে নিয়েই বাকি দিনগুলি বেঁচে থাকবে।
রাতের অন্ধকারে তারারা যখন মিটমিট করছে। বাড়ির সকলেই যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ।তখন অনামিকার সেই চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে আস্তে আস্তে নীল রঙের খামটি খুলে সে দেখে,
"বিশ্বজিৎ আমি আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি ।গত বছর আমার স্বামী বিষাক্ত মদ খেয়ে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায়। তারপর থেকেই আমি বড় একা হয়ে গেছি। এভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না ।তুমি ভালো থেকো.........।"
ইতি
তোমার অনামিকা 
স্টেশন রোড, নিউ জলপাইগুড়ি

...চিঠিটা পড়ে বিশ্বজিতের মনের মধ্যে যে ভালোবাসার ঝড় উঠে , সেই ঝড় তাকে আর স্থির থাকতে দেয়না। বহুদিনের সুপ্ত ভালবাসা আবার জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মত জেগে ওঠে।
তাই বেশি দেরি না করে বিশ্বজিৎ সকালে আদ্রা স্টেশনে "গৌয়াহাটি এক্সপ্রেস" ওঠে পড়ে । অনামিকার ভালোবাসার টানেই সে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। স্টেশনে নেমে চিঠিতে দেওয়া ঠিকানায় বিশ্বজিৎ রওনা হয়।সেখানে পৌঁছে দেখে ঐ ঠিকানায় কেউ নেই। বাড়ির দরজা মনে হয় ভেতর থেকে বন্ধ ।বিশ্বজিৎ দীর্ঘক্ষণ ডাকা ডাকির পরও কেউ সাড়া দেয়নি। রাগে দুঃখে বিশ্বজিতের চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে ।কোন উপায়ন্তর না দেখে স্থানীয় কিছু মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলে। ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখে, মেঝেতে পড়ে আছে এক টুকরো সাদা কাগজ, তাতে রক্ত দিয়ে লেখা...
"তুমি বিশ্বাস করো বিশ্বজিৎ। আমি এভাবে কখনোই মরতে চাই নি ।আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আর বাঁচতে পারলাম না ।পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।" 

বিশ্বজিৎ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কোন রকমে দেওয়ালে হেলান দিয়ে, মাথায় হাত নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে।


...................সমাপ্তি................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন