মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

স্বার্থপর




যে যাই বলুক, কলেজ লাইফে ক্যাম্পাসে বসে বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে একসাথে  আড্ডা দেওয়ার আনন্দই আলাদা।  যারা শুধু পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে, একদিনের জন্যও জমিয়ে আড্ডা দিয়ে পারে নাই তাদের জীবনটাই বৃথা।
কি বলিস রে পচা! তাই না? কলেজ ক্যাম্পাসে পাশাপাশি বসে থাকা পচার পিঠ টা আদর করে চাপড়াতে চাপড়াতে বলে ধনা।ধনার ভালো নাম ধনঞ্জয়।
...তা কিছুটা হলেও সত্য বটে।তবে সবটা নয়।উদাস মনে বলে পচা। 

ধনা, পেন্টের পকেটে লুকিয়ে রাখা সিকারেট বক্সটি আস্তে আস্তে বার করে। সিকারেট খাওয়া তার বহুদিনের অভ্যাস। না খেলে মনটা কেমন খুত খুত করে। কোনো কাজেই তাঁর মন বসে না। এই নিয়ে বাড়িতে বাবার কাছে কম বকুনি খেতে হয় নাই। ক্লাস সিক্স কি সেভেন হবে ,ঠিক মনে নেই।একবার তো সিকারেট খাওয়ার অপরাধে তার বাবা হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে মেরে মেরে আধ মরা করেছিল। ধনার মা না থাকতে বোধহয় মেরেই ফেলত। মায়ের চেষ্টায় সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল।তবুও সে শিক্ষা পায় নি।সিকারেটের বক্সটি খুলে একটি সিকারেট বের করে মুখে দেয়। দেশলাই বের করে সেই আগুনে সিকারেট টি সে ধারায়। 
তারপর একবার মনের আনন্দে টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়া  উপরের দিকে মুখ করে ফুঁ দিয়ে, একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বিজ্ঞ জনের মতো  বলে, জানিস,পচা। সবাই স্বার্থপর রে। পৃথিবীর সবাই আর্থপর। বলেই আর একটা টান দেয়।

পচা,ধনাকে ভালো ভাবেই চিনত।বছর তিনেক আগে তাদের পরিচয় হয়।  কোনো জাদুতে যে দুই জন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা,বন্ধুতে পরিণত হয় সেই জাদুর কথা,পচা আজও ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারে নাই। ধনার সাথে তার স্বভাবে মিলের থেকে আমিলই দেশি। পচা মাধ্যমিক পাস করে ধনাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল।তাদের দুজনের বাড়ি স্কুল থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হলেও কেউ কাউকে এর আগে চিনত না।উচ্চমাধ্যমিক থেকে আজ পর্যন্ত সেই গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব  অটুট আছে। যদিও স্কুলে দুজনের মধ্যে একবার একটু মনোমালিন্য হয়েছিল বটে,তবে সে মনোমালিন্য বেশি দূর গড়ায় নি।
পচা একটু হেসে বলে, সবাই স্বার্থপর নয় রে! কেউ কেউ স্বার্থপর!

...তাড়াতাড়ি মুখ ভর্তি সিকারেটের ধোঁয়াটি উপরের দিকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায়  ধনা বলে,লাল্টু,পল্টু,বিকাশ, আকাশ......কাকে, ভালো বলব?তুই-ই বল দেখি! শালারা কেউ সম্পর্ক টুকুও আজ আর রাখে না।
...ওরা না রাখুক। তোরও তো সম্পর্ক রাখা উচিত ছিল।
...জোরে একবার টান দিয়ে,অবশিষ্টাংশ সিকারেট টি কলেজ ক্যাম্পাসে চিরসবুজ ঘাসের উপর ছুঁড়ে দিয়ে,পচার প্রশ্নটি কৌশলে এড়িয়ে,জলন্ত সিকারেট এর উড্ডীয়মান ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে তাকিয়ে,মুখটা বিকৃত করে বলে, যাক।তাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম ।কিন্তু নীলিমার কথা?সে কি স্বার্থপর নয়। তাকে স্বার্থপর বলব ,না তো আর কাকে স্বার্থপর বলব?

...পচা, ধনা-নীলিমার অতীত ইতিহাস সবটা না জানলেও কিছু কিছু জানে। তাই শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ধনা, একবার শরতের পরিস্কার আকাশের ভাসমান ছোট ছোট মেঘের ভেলায় দিকে তাকায়।তারপর ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের দিয়ে তাকিয়ে বলে, নীলিমা কি আমার জন্য একটি বছর অপেক্ষা করতে পারত না?
...পচা,মানে পঞ্চানন বাউরি। কোনদিনই কারো সাতেপাচঁ এ থাকে নাই।খুবই সাধারণ সহজ,সরল ছেলে।তবুও সে বলে, নীলিমার দোষ দেওয়া বৃথা।তার কি দোষ? তার বাবা.....
...থাক ।তোকে আর তার হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। বলেই মুখে ভেংচি কেটে বিরক্তির সুরে বলে, তার বাবা।যতসব.....।সে ইচ্ছা করলে বাবাকে বোঝানো কি এমন কঠিন কাজ ছিল?পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই, যা ইচ্ছা থাকলে করা যায় না।

দু জনেই একটুক্ষন চুপচাপ থাকে। কেউ কথা বলে না।। অজানা কারণে দুজনেই নীরবতা পালন করে। গাছের নিচে বসে থাকা ধনার মাথার উপরে কি একটা পড়ল। ধনা,তাড়াতাড়ি মাথায় হাত বুলিয়ে নীরবতা ভঙ্গ করে,গাছের  উপরের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি পাখিকে লক্ষ্য করে ,বিরক্তির সুরে বলে, শালা, এদের জ্বালায় দুদন্ড যে বসে আরাম করবি।তাও হবে না। সব শালা স্বার্থপর! কেউ কম যায় না।
পচা, ধনার মাথার দিকে তাকিয়ে একটু হাসব হাসব করে,কিন্তু মুখের দিকে তাকাতেই সেই হাসি কোথায় হারিয়ে যায়। সে আর হাসতে পারে নাই। এতদিন ধনাকে সে কাছ থেকে দেখছে,কিন্তু তাঁর মুখের রূপ যে,এমন দেখতে হবে,তা ইতিপূর্বে কোনোদিন দেখে নাই। খুব দুঃখ পেলেও কোনোদিন তাঁর মুখটা এমন পাংশু,বিবর্ন হয় নাই।


...ধনা, আরেকটা সিকারেট পকেট থেকে বার করে ধারায়।,একটাছোট্ট টান মেরে বলে, আমি কি নীলিমাকে ভালোবাসি নাই? নিজের জীবনের চেয়েও তাকে অনেক বেশি ভালো বেসেছি ।তাঁর জন্য আমি কি করি নাই? সব করেছি।
একটা জোরে  দীর্থশ্বাস ফেলে আবার বলে, যেদিন  ক্লাসের জানালায় চাপা পড়ে তাঁর হাত কেটে ঝর ঝর করে রক্ত বের হয়ে ছিল,সেদিন কে এগিয়ে এসেছিল? এই ধনা-য়, সেদিন রুমাল দিয়ে হাতটা শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। সে কথা নীলিমা কি করে ভুলে গেল? আর ভুলবেই না কেন? যারা স্বার্থপর হয় ।তারা সব কিছু ভুলে যায়। শুধু নিজের স্বার্থ টা কখনো ভুলে নাই। নীলিমা তাদেরই প্রতিনিধি।


...পচা, এতবড় অভিযোগের কোন উত্তর না দিয়ে, অতীত স্মৃতির অন্তরালে একটু উঁকি দেয়,....
নীলিমা স্কুলে পড়াশুনায় কোনোদিন ই প্রথম হতে পারে নি ঠিকই তবে দেহের রূপ যৌবনের সৌন্দর্য্যে গোটা স্কুলের ছাত্রীদের পিছনে ফেলে বিনা বাধায় প্রথম স্থানটি অধিকার করতে পারে। দেখতে বিশ্বসুন্দরী না হলেও অতীব সুন্দরী এ কথা স্কুলের ছাত্র থেকে মাস্টার মশায় কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। বসন্ত কালে গাছের প্রস্ফুটিত ফুলের পরিমল সিঞ্চনের জন্য যেমন মৌমাছির ঝাঁক সেই ফুলের চারপাশে ঘুর ঘুর করে, তেমনি নীলিমার অনন্ত রূপরাশির তীব্র আর্কষনে স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে সমুদ্রের স্রোতের মতো শিক্ষক মশায়দের দৃষ্টির অন্তরালে প্রবল প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। সেই প্রতিযোগিতায় সকলকে পিছনে ফেলে ধনঞ্জয় জয়ী হয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে নীলিমার নরম কচি হাতটি ধনায় এক সময় পরম আদর যত্নে ধরে। প্রথম থেকে  শেষ পর্যন্ত এই চিত্রনাট্যের একমাত্র ভালো দর্শক পচা।

ধনঞ্জয় যেমন নীলিমাকে ভালোবাসে, তেমনি নীলিমা ও ধনাকে ভালোবাসে। এতে স্কুলের  কিছু ছেলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত। কিন্তু নীলিমা তা গ্রাহ্য ই করত না।দেখেও না দেখার ভান করত।

গত বছর স্কুলের সরস্বতী পূজোর দিন। স্কুল থেকে পচা, ধনা,আর নীলিমা পার্কে যায়। সেদিনই তারা প্রথম স্কুল পালিয়ে পার্কে আড্ডা দেয়। সেখানে নীলিমার প্রস্ফুটিত যৌবনের প্রথম অধর সুধা পান করে ধনঞ্জয়।নীলিমা ধনঞ্জয় এর হাতটি বুকে ধরে কম্পিত ঠোঁটের স্পর্শে আলপনা এঁকে বলেছিল."সারা জীবন আমি তোমারই থাকব।পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।"সেই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী পচা।
...কি রে পচা? তুই কিছু বলবি নাই? দোষটা কি আমার ছিল? না, নীলিমার ছিল?  পিঠে হাত দিয়ে পচার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ধনঞ্জয়।
....দেখ,ধনা। আমি বিচারক নয়। তবেএইটুকু  বলতে পারি, দুজনেরই কিছু কিছু দোষ আছে। এক দশে কখনই কুড়ি হয় না। কারো দোষ কম।কারো দোষ বেশি।এই যা পার্থক্য।
মনে মনে বলে, যখন নীলিমার বিয়ের দেখাশুনা চলছে। বাড়িতে বলেছে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেই বিয়ে দেবে। সে খবর নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ধনঞ্জয়কে জানিয়েছিল। তাঁর দোষ দেওয়া আজ বৃথা। বাড়ির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস ক জনেরই  বা আছে?তবুও নীলিমা তাদের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বাড়িতে জানিয়েছিল। সে সব কথা ধনঞ্জয় জানত।কিন্তু বাড়ির লোক যদি....
....তুই ও শেষে আমার দোষ দেখতে পেলি রে?আক্ষেপের স্বরে বলে ধনা।
....শুন ভাই। দোষ কোনোদিন চাপা থাকে না।
....সব দোষ আমার। সে বিয়ে করল।কিন্তু,আমাকে বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পর্যন্ত দিল না। তবুও সব দোষ আমার ।ধনঞ্জয় উদাস সুরে কথা গুলি বলে।
....তুই সব দোষ নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। আমি তা কখনও বলি নাই ।আর হ্যাঁ। নীলিমার অন্তঃত নিমন্ত্রণ করাটা উচিত ছিল।.....

হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ধনা বলে, আরে চল। চারটা বেজে পেরিয়ে গেছে। টিউশনি আছে। ....

হেঁটে দুজনেই কলেজ গেটের সামনে এসে উপস্থিত হয়।তারা দুজনেই একই মাস্টারের কাছে একই সময়ে  টিউশনি পড়ে। টিউশনি দেরিতে পৌঁছলে মাস্টার আর ঢুকতে দেয় না। তাই একটু ভয়ে ভয়ে আছে।একটু পরেই ধনা, পচাকে ছেড়ে একজন পরিচিত বন্ধুর বাইকে উঠে বসে।

পচা করুণ গলায় বলে, আমি কিসে যাব রে ধনা?
...ধনা,একটু মৃদু হেসে বলে, সে আমি জানি নাই। আমি কি ঠিকেই নিয়েছি নাকি?বলতেই  গাড়ির ড্রাইভার  একগুচ্ছ ধূলো বলি উড়িয়ে পচা কে অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায় নিল।

...পচা, চলে যাওয়া গাড়িটির কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, একা দাঁড়িয়ে অস্ফূর্ত স্বরে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে থেমে গেল ।সেই একটিমাত্র শব্দটি হল "স্বার্থপর"।

20/09/2019






কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন