বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

ঠোঁটের কোণে সেই মিষ্টি হাসিটা

এই কিছুদিন হলো লালগড়ের এক বেসরকারি কোম্পানির কাজে যোগ দিয়েছি । এই লালগড় "মাওবাদী লালগড়" নামে গোটা বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত ।
প্রথমে আমি কাজে যোগ দিতে ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু এম.এ ,বি.এড পাস করে আর কতদিন বসে বসে বাপের হোটেলে খাবো! নিজেরও তো একটা আত্মসম্মান বলে জিনিস আছে। তাছাড়া বাবা-মা মুখ ফুটে কোনও দিন  কিছু না বললেও তারাও  চায় যে আমি কিছু একটা কাজ করি। অন্তত নিজের সামান্য  হাত খরচটা চালানোর মতো উপার্জন করলেও বাপের কাছে আর হাত পাততে হবে না,..... এই ভেবে বেসরকারি কোম্পানির কাজে যোগ দিই।

সবাই জানে কোম্পানির কাজে একটু চাপ বেশি থাকে।তবুও রবিবার দিনে কর্মব্যস্ততার শৃঙ্খল ছিন্ন করে  মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখনা মেলে সারা লালগড় মুক্ত সিংহের মতো চোষে বেড়ায় ।লালগড়ের বুকের উপরে যে নদীটি নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে কুলকুল শব্দে গান গাইতে গাইতে বয়ে চলেছে তার নাম...কংসাবতী।
এই নদীর সদ্য পাথর বিছানো পাড়ে বসে আমি কাটিয়েছি কত সোনালী বিকেল। নির্জনে বসে প্রকৃতির সাথে খেলা করার যে কি আনন্দ! যারা খেলার সঙ্গী, তারায় একমাত্র জানে। সেদিনও সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে,প্রকৃতির সাথে খেলতে খেলতে, কানে হেডফোন লাগিয়ে মোহাম্মদ আজিজ এর গান শুনছি।
নদীর পাড় ধরে পিচঢালা যে সরু রাস্তাটি জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। সেই রাস্তায়
খুব একটা গাড়ি-ঘোড়া চলে না। হঠাৎ"দড়াম" করে একটা আওয়াজ। হেডফোনের গানের সুরকে চাপিয়ে এই আওয়াজ আমার কানে এসে সজোরে ধাক্কা মারল। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, পাশেই একটি মেয়ে লাল রঙের স্কুটি চাপা নিয়ে পড়ে আছে।নিজের থেকে উঠবার ক্ষমতা টুকু নেই। গাড়ি চাপা নিয়ে ছটপট করছে। হয়তো নতুন ড্রাইভার!নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে দুই হাত ধরে টেনে তুলি। থর থর করে সে  কাঁপছে । সম্ভবত খুব ভয় পেয়েছে।
আমি লাল রঙের স্কুটি টি তুলতে তুলতে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই ।যা হবার হয়ে গেছে । ভাগ্য ভালো যে, তোমার কিছু হয়নি। খুব জোর বেঁচে গেলে । সে মুখ দিয়ে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।জানিনা সে কি ভাবছে!
"....কি নাম ?"বিহ্বল ভাব কাটিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করি।
আমার প্রশ্নের উত্তরে সে  জানালো প্রিয়া, ভালো নাম বিষ্ণুপ্রিয়া।
".... তুমি কি করো?" উৎসাহভরে জানতে চাইলাম।
সে একটু স্মিত হেসে আমাকে আড়চোখে দেখে বলে,"লালগড় গভমেন্ট কলেজে ।ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।"

পশ্চিমের সোনালী সূর্যটা ঘন শাল গাছের দিগন্তের পারে অস্ত চলে গেছে। এই সময় এমন নির্জন জায়গায় কোন মেয়ের সাথে কথা বলা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়!অন্য কোনো শহরের জায়গা হলে তাও সম্ভব।লালগড়ের মত মাওবাদী প্রভাবিত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে একা কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলা !কল্পনা করা যায়??
....এ কথা মনে হতেই আমার গা কাঁটা দিয়ে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খাঁড়া ওঠে। প্রিয়াকে বললাম, গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে পারবে তো?
সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
আমি  স্কুটিটি স্টার্ট করে তাকে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, সাবধানে যেও কেমন!
গাড়িতে চেপে একগুচ্ছ ধুলোবালি উড়িয়ে,আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে লাল স্কুটিটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
হেডফোনে গান শুনতে শুনতে আমি নিজের ভাড়া বাড়িতে চলে এলাম। নরম বিছানা পেয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম।
              *************(2)*************
আমি তখন কলেজে পড়ি। আমার গ্রামের পাশেই কলেজ ।তাই আমি সাইকেলে করেই প্রতিদিন কলেজে যেতাম।
এই যাওয়া-আসার পথে ময়না বলে একটি মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে আমার খুব  ভালো বন্ধবী ছিল ।আমি তাকে কেবলমাত্র বান্ধবী ই ভাবতাম।এর বেশি কিছু কোনোদিন ভাবি নি।
ভালোবাসার অনুভূতি যে কেমন ! তা আমি সেই সময় জানতাম না ।জীবনে কোন মেয়ের প্রেমেও পড়ি নি।আমি এক সাধারন কৃষকের ছেলে ।প্রেম, ভালোবাসা অনেকটা বড় ঘরের ছেলে মেয়েদেরই মানায় ।আমার মত গরীব ছেলের প্রেম করা নৈব নৈব চ। কলেজ লাইফে এটাই ছিল আমার দৃঢ় বিশ্বাস । বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো শোভা পায় না ।তবুও "ময়না" বলে সেই মেয়েটি কিন্তু আমাকে মনে মনে ভালোবাসত। যদিও এ ভালোবাসা একতরফা ছিল। তার সমস্ত ভালোবাসা  এক সময় আমাকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি অবহেলায় তা প্রত্যাখ্যান করেছি।

টেবিলে রাখা মোবাইলটির রিংটোন বেজে উঠলো।এই সময় আবার কে ফোন করেছে ?উঁকি দিয়ে একটু ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি লেখা উঠছে মিস্টার বস!
মনে আমার অফিসের বস ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই জানতে পারি, আজ লালগড়ের পাশে এক আদিবাসী গ্রামে সার্ভে করতে যেতে হবে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যে গাড়িতে করে আমরা গ্রামে গ্রামে সার্ভে করি ,সেই সার্ভে গাড়িতে উঠে বসলাম।
এই কদিনেই আমি লালগড়টাকে আপন করে নিয়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি। এখানকার মানুষজন প্রকৃতির মতই নিষ্পাপ, সহজ সরল ।সহজেই এই মানুষগুলি অপরিচিত অতিথি কে আপন করে নিতে পারে।এখানে না এলে আমি জীবনে কোনদিন বুঝতেই পারতাম না, এখানকার মানুষজন এত অতিথি পরায়ন হতে পারে! 
দুদিকে শাল জঙ্গলের বুক চিরে একটি সরু কাঁচা মরোমের রাস্তাটি গ্রামের দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়েই আমাদের সাদা গাড়িটি জঙ্গলে পড়ে থাকা শালগাছের শুকনো পাতাগুলিকে সাথে উড়িয়ে উড়িয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাড়ির জানলা দিয়ে আমি প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি।গোটা জঙ্গলে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে।পাখির কিচিরমিচির ডাক পরিবেশ কে আরোহৃদয়গ্রাহী মনোরম করে তুলছে।কাঁচা রাস্তাটি পেরিয়ে ঢালাই রাস্তার দুইধারে দু একটি কাঁচা মাটির বাড়ি পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে আমি নামতেই ,একটি মেয়ে " ও বাবু" বলে ডাক দিল।
আমি তাকিয়ে দেখি,একটি মেয়ে কাঁখে মাটির কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেই দেখি, জলপূর্ণ মাটির কলসিটা থেকে উপচে পড়া জলে মেয়েটির নীলচে রঙের চুড়িদারটির  কিছুটা অংশ ভিজে গেল।
আমি কিছু বলার আগেই, "আমাকে চিনতে পারলেন বাবু?" মেয়েটি লাজুক ভাবে বলল।
মেয়েটির উচ্চতা পাঁচ ফুটের কাছাকাছি।
দেখতে মাঝারি গড়নের। মাথায় শাল ফুলের যেন খোঁপা বাঁধা আছে। তখনও আমি মেয়েটিকে  ঠিক চিনতে পারি নি।যেই সময় তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে যাব,এমনি সে বলে উঠল,
"আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।
কলেজে পড়ি ।লালগড় কলেজে।
আমাকে চিনতে পারছেন না!
আপনিই তো সেদিন আমাকে বাইক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়েছেন।'
...... ও বুঝেছি। বুঝেছি ।একটু হেসে আমিও বললাম।
....."আসুন আমাদের বাড়ি।" গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে একটু  মিষ্টি হেসে বলে । সেই হাসি কি সুন্দর! হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে পড়েছে।
"..... কোনখানে তোমার বাড়ি ?" শান্ত ভাবেই আমি জানতে চাইলাম।
বিষ্ণুপ্রিয়া নারকেল গাছের মাথার ওপারে একটি মাটির বাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। তখনও ঠোঁটের কোণে লেগে আছে সেই মিষ্টি হাসি।
               *************(3)***************
সার্ভে থেকে ফিরে এসে নিজের বেডরুমে সোফায় হেলান দিয়ে হেডফোনে আমার সেই প্রিয় গায়ক মোহাম্মদ আজিজ এর গান শুনছি। কিন্তু আজ আর গান ভালো লাগছে না ।কেন জানিনা ,দেয়ালে দেয়ালে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠোঁটের কোণে সেই মিষ্টি হাসিটাই মনে পড়ছে। তার হাসিটা আমাকে যেন পাগল করে তুলেছে। কলেজে যখন পড়তাম তখন ভালোবাসা যে কি জিনিস বুঝিনি। কিন্তু আজ কেন আমার হৃদয় জুড়ে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়া!

এখন প্রতি রবিবার আমি সময় করে বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে কংসাবতী নদীপাড়ে দেখা করি। এখানেই তো তার সাথে আমার প্রথম দেখা।আমার ভালো লাগা।ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।আমাদের দুজনের মধ্যে ধ্যান-ধারণার, মনের, এক অদ্ভুত রকমের মিল ছিল। ইদানিং দুজন দুজনকে ছাড়া এ জগত অন্ধকার দেখতে পাই।কোন কোন দিন পাখিরা যখন একে একে নিজের বাসায় ফিরতে শুরু করেছে, তখনও আমরা দুজনে পাশাপাশি কংসাবতীর নদীর পাড়ে বসে বসে একটি, দুটি,তিনটি করে পাখি গুনে চলেছি।সব পাখি যখন গোনা শেষ হতো তখন আমরাও বাড়ি ফিরতাম।


আগুনের সামনে ঘি থাকলে যেমন একটু একটু করে হলেও ঘি গলতে শুরু করে।সম্পর্ক যখন খুব গভীর হয় তখন রক্তমাংসের শরীর কখনো কখনো কাছাকাছি চলে আসে। তখন শরীরও  কথা বলতে শুরু করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া আমাকে হঠাৎ তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,  "যদি কোনদিন আমি তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাই । তুমি কি করবে?"
আমি এক হাতে তার মুখ চাপা দিয়ে বলি, এমন কথা আর কখনো মুখে আনবে না। তোমাকে ছাড়া আমি যে বাঁচতে পারব। তুমি আমার জান, তুমি আমার জ্ঞান, তুমি আমার ধ্যান।
.....".চল না , আমরা দুজনে পালিয়ে বিয়ে করি।"
আমার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে সে বলে।
বিষ্ণুপ্রিয়ার মাথার শেম্পু করা চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে আমি বললাম ...
না,না,আমি পালিয়ে গিয়ে কখনই বিয়ে করতে পারবো না। বাবা-মাকে বুঝিয়ে অনুষ্ঠান করে, আর  পাঁচজন  মানুষ যে ভাবে বিয়ে করে,আমিও সেভাবেই তোমাকে বিয়ে করব। তুমি কিছু চিন্তা করো না।  স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব।
              ****************(4)******************
রাত দশটার সময় কোম্পানি থেকে এমার্জেন্সি ডাক এলো ।পরের দিনেই আমাকে দার্জিলিং যেতে হবে।কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া কে খবর টা আমার আর দেওয়া হলো না।"যে আমি দুমাস পরে ফিরে এসে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে সব কথা জনাব।" যাকে  দুদণ্ড না দেখলে মনটা আনচান করে ,তাকে দুমাস দেখতে পাবো না ।কোনো কথা বলতে পাব না। এটা ভেবেই মনটা বিষাদে ভরে উঠল। কিন্তু কি আর করা যায় কোম্পানি চাকরি! যেতে তো হবেই ।অগত্যা দার্জিলিং পাড়ি দিলাম।
দার্জিলিং জায়গাটাও আমার বেশ ভালই লাগলো। এখানে চা বাগানের দৃশ্য, পাহাড়ের কোলে টাইগার হিলের সূর্যোদয়.....।তবুও দিনের শেষে ,দার্জিলিং এ থাকলেও আমার মন পড়ে থাকতো সেই লালগড়ে ই।দার্জিলিংএ রাত্রে ঠিক মতো আমার ঘুমও হয় না।বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায় মনে পড়ে।
জানিনা এখন বিষ্ণুপ্রিয়া কেমন আছে? কি করছে?
কিন্তু আমার মন বলছে সে ভালো নেই ।প্রতিটা মুহূর্ত তাকে দেখার জন্য আমার মন ছটফট করছে। আর দেরি নয়, আমি বাড়ি ফিরেই বিষ্ণু প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ের পাকা কথা সেরে নেবো। আমার কথা বাড়ির বাবা-মা কেউ অমান্য করতে পারব না ।এটুকু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে।
দেখতে দেখতে দার্জিলিংএ আমার নিরানন্দ ভাবে বহু কষ্টে দুটো মাস কেটে গেল। আগামীকালই  আমি লালগড় ফিরে যাব। সেখানে গিয়ে প্রথমে বিষ্ণুপ্রিয়া কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। আশা করি সে আমাকে ক্ষমা করে দেবে। হঠাৎ ই তাকে না জানিয়ে দার্জিলিং চলে এসেছি।

রাতের ট্রেনেই আমি হাওড়া চলে আসি।তারপর লালগড়।.......
লালগড়ে নেমেই প্রথমে আমি আমার হবু জীবনসঙ্গিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার খবর নিই। বিষ্ণুপ্রিয়ার একমাত্র ছোট ভাই কাঁদিতে কাঁদিতে জানালো, তার দিদি আর বেঁচে নেই। 

গত মাসেই সর্প দংশনে বিষ্ণুপ্রিয়া এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ,সমস্ত পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে, না ফেরার দেশে চলে গেছে।........



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন