বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

জীবন- তরী

ভালোবাসার মানুষটির সাথে চার হাত এক হওয়ার যে কি অনাবিল আনন্দ! সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বোধ হয় পাওয়া সম্ভব নয়।হাজার ঝড় ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে জীবন তরীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া ,শুধু মুখের কথা নয়। খুবই জটিল কাজও বটে। আর সেই জটিল কাজও সম্ভব হয়ে ওঠে, যদি তাদের ভালোবাসা খাঁটি সোনার মতো হয়। সেই ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করে অবিকল আর অঞ্জনার মতো সুখী আজ আর কেউ নয়। কোর্ট থেকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে অঞ্জনা তার বরের হাতটি ধরে পায়ে পা মিলিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে অবিকলের শরীর ঘেঁষে কনুইটে আলতো করে ঠেকিয়ে,নাড়া দিয়ে বলে,
" তুমি এত সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পারো, আমি ভাবতেই পারি না!'
অবিকল প্রথমে অঞ্জনার মুখের দিকে,তারপর মাথার সদ্য লাল টুকটুকে সিঁদুরের দিকে আড় চোখে একটু তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, 
"এছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না অঞ্জনা।"

কিছুটা পথ হাত ধরে হাঁটার পর, কোর্টের মেন গেটের কাছে একটি লম্বা চেয়ার ছিল, যেমনটি রেল স্টেশনে দেখা যায়, সেই চেয়ারে গিয়ে তারা দুজন বসে পড়ে।কত হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে আজ এখানে তারা পৌঁছেছে! সে পথ মোটেই মসৃন ছিল না।সে কথা মনে হতেই অবিকলের সারা গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কণ্টকাকীর্ণ সে পথ। তবুও তারা সে সব বাধা অতিক্রম করে কিভাবে বিজয়ী হল,সে কথায় ফিরে আসি।
অঞ্জনার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে তার মা বলে, "যা একবার তোর ছোট মাসির বাড়ি ঘুরে আয়। তোর মাসি সেদিনও ফোন করে বলেছে, তোর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে যেন একবার মাসির বাড়ি ঘুরে আসিস।"
অঞ্জনার তার মায়ের প্রস্তাবটি শুনতে খুব মন্দ লাগলো না ।উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রায় মাস দুয়েক ছুটি পাওয়া যায়। তাছাড়া পরীক্ষার সময় রাত জেগে অনবরত পড়ে পড়ে দেহ, মন... দুই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জীবনটাও কেমন যেন একঘেয়েমি হয়ে ওঠে।সবারই শরীর রক্ত মাংসে গড়া।শরীর তো কোনো যন্ত্র নয় ।তারও তো মুক্তি চাই, ছুটি চাই।তাছাড়া অঞ্জনার যখন বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে, সে সময় অঞ্জনা মাসির বাড়ি গেছে ।আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি।মায়ের প্রস্তাব শুনে আনন্দে লাফাতে লাফাতে সে জানাই...
"ঠিক আছে।তবে কালকেই যাব।"
অঞ্জনার ছোট মাসির বাড়ি পুরুলিয়ার ভাট বাঁধ এর কাছে। বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় এই মুহূর্তে তার ঠিক  মনে নেই। তবে তার মাসির নাম অপর্ণা রায়।মাসি পুরুলিয়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে চাকরি করে। ...এটুকু তার স্পষ্ট মনে আছে। অঞ্জনা ভাট বাঁধ মোড়ে একটি পান দোকানের কাছে গিয়ে তার মাসির পরিচয় দিয়ে জানতে চাই মাসির বাড়িটা কোন খানে? সে সময় পান দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যুবক  অপরিচিত মেয়েটিকে বিনম্র ভাবে বলে,
"কোন অসুবিধা না থাকলে আমি তোমাকে উনার বাড়ি দেখিয়ে দিতে পারি। আমার বাড়ি ওইখানেই।আমরা একই পাড়ায় থাকি।"


অঞ্জনা প্রথমে অপরিচিত লোকের সাথে যেতে একটু ইতস্তত করে। তারপর দিনের মাঝে ব্যস্ত রাস্তায় কি আর হবে !.....এই ভেবে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে, "ঠিক আছে। চলো ।


কলেজ ইনফর্ম পরা ছেলেটি তার নিউ হিরো সাইকেলটি একটি হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,...." তুমি এই প্রথম মাসির বাড়ি আসছো নাকি?"
..অঞ্জনা সহজভাবেই বলে , "তা হয়তো ঠিক নয় ।একবার খুব অল্প বয়সে এসেছি। তাই বাড়িটা ঠিক মনে পড়ছে না।"

সেই অপরিচিত ছেলের সাথে পায়ে পা মেলে ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পিঠের ব্যাগটা সাইকেলের ক্যারিয়ারের নামিয়ে দিয়ে বলে, "তোমার নামটা কি আমি জানতে পারি ?"
...অবশ্যই ।আমার নাম অবিকল। তোমার?
... অঞ্জনা। পুরো নাম অঞ্জনা রায়।
... বাহ কি মিষ্টি নাম!
নামের প্রশংসা শুনে, অঞ্জনার শুধু ওষ্ঠাধর একটু প্রসারিত হয়। তারপর একটু ফিক করে হেসে বলে, "তুমি কি কর?"
...কলেজে পড়ি। তুমি?
....আমার তো এই সবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হল।
..."এই তো !এসে পড়েছি। ওই সবুজ রঙের দেওয়াল, এডবেস্টার লাগানোর নতুন বাড়িটাই তোমার মাসির বাড়ি।" অবিকল থমকে দাঁড়িয়ে ডান হাতের আঙুল নির্দেশ করে বলে।
..." ও আচ্ছা !ধন্যবাদ ।"..বলে অঞ্জনা সাইকেলের কেরিয়ারে রাখা তার ভারী ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে,হেলতে দুলতে চলে গেল ।
অবিকলও "ওয়েলকাম"জানিয়ে পাশের গলি দিয়ে তাদের দোতলা বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
অবিকলের বাবা এক সময় খুব উঁচু পোস্টে রেলওয়েতে সার্ভিস করতো। বর্তমানে রিটায়ার করার পর একটা বড় গোলদারি দোকান দিয়েছে।এখনও ওই পাড়ায় তিনিই সম্ভবত আর্থিক দিক দিয়ে বিচার করলে বড়লোক । গোটা পাড়া তাকে কৃপণতার জন্য এক ডাকে চেনে।


অঞ্জনা গ্রাম্য মেয়ে। গ্রামের গাছপালা প্রকৃতির মতোই সহজ-সরল। তার সাদা মনে কাদা নেই। এই সহজ-সরল স্বভাবের কারণে অবিকলের সাথে অচিরেই  বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।অবিকলও ওই একই স্বভাবের উদার হৃদয়ের মানুষ।
সেদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে পাড়ার মোড়ে একটি পান দোকানে অবিকল সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠে কে যেন একটা নরম হাত ঠেকাল।সে ভুত দেখার মত চমকে পিছন ঘুরে দেখে, অঞ্জনা পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে হাসছে।
.... "ভয় পেলে নাকি ?"অঞ্জনা হাসতে হাসতে বলে।
ভয়টা কেউ যাতে বুঝতে না পারে,তাই অবিকল গলা খাঁকারী দিয়ে বলে,
"না, না ,ভয় পাবো কেন ?"
অঞ্জনা বুঝতে পারে একটু হলেও অবিকল ভয় পেয়েছে।পিঠের থেকে হাতটি সরিয়ে সাইকেলেটি ধরে বলে, "তুমি এখন বাড়ি যাবে তো?"
... "হুম" অবিকল শুধু একটি শব্দ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, চুপ করে থাকে।
"চলো ।তাহলে আমিও যাই ।"..এই বলে অবিকলের সাইকেলে বসে পড়ে ।
সাইকেল চালাতে চালাতে অবিকল জিজ্ঞাসা করে, "উচ্চ মাধ্যমিকের পর তুমি কি নিয়ে পড়াশোনা করবে ?"
..."মাসি বলেছে "জি এন এম," করতে।কিন্তু আমার তো ইচ্ছে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে পড়বো।" ..অঞ্জনা আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠে।
....." দুটোই ভালো এরপর তোমার যেটা ইচ্ছা সেটা করো।" কথা গুলো অবিকল আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে যায়।
আরো হাজার কথা আদান- প্রদান করতে করতে তারা সেদিন বাড়িতে পৌঁছে।
  
  ★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে অঞ্জনা নিস্তারিনী ওমেন্স কলেজে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। মাসি বাড়ি থেকে কলেজ যাতাযাত করার ফলে এখন প্রায়ই অবিকলের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। অচিরেই তাদের বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিনত। কলেজ থেকে ফেরার সময় পুরুলিয়া সুভাষ পার্ক এ এখন বেশিরভাগ সময় তাদের কাটে। দুজন মিলে সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া, সাইকেলে চেপে বাড়ি ফেরা,.... গ্রামের অনেকেই চোখে ভালো ঠেকে না। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও দুজন ছেলে মেয়ের প্রেম- ভালোবাসা অনেকেই খোলা মনে মেনে নিতে পারে না। যত হোক না কেন, এটা একবিংশ শতাব্দী।গ্রামের প্রতিবেশীরাই তিলকে তাল করে তাদের মেলামেশার সমস্ত ঘটনা মাসিমার কানে দেই। অভিযোগ শুনতে শুনতে যখন মাসির কান ঝালা পালা হয়ে ওঠে, তখন অঞ্জনাকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে তার মাসি হাফ ছেড়ে বাঁচে। মাসি ভাবল, যাক আপদ মিটে গেল।এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।কিন্তু না।
এই ঘটনাগুলি ঝড়ের বেগে এক কান থেকে আরেক কানে যেতে যেতে অবিকলের বাড়িতে আছড়ে পড়ে।

অবিকলের বাবা ছেলের কীর্তি শুনে রেগে অগ্নিশর্মা। তার মনের সুপ্ত বাসনা ছিল, যে ছেলের বিয়ে দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকা হাতে পাবে। সেই গুড়ে বলি! সে ভাল করে জানে,ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করে বাড়িতে বৌ তুললে একটা কানাকড়িও মিলবে না। তাই সে অবিকলকে ডেকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে, সর্বশেষে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেই, যে "গরিব ঘরের মেয়ে অঞ্জনা"-কে সে এ বাড়ির বউ বলে কখনোই মেনে নেবে না।
অঞ্জনা যে দিন মাসির বাড়ি থেকে একপ্রকার বিতাড়িত হয়ে নিজের বাড়ি গেল।সেদিন থেকেই সে গৃহবন্দি। ঘর থেকে বেরুনোর জো নেই। সাথে সাথে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।বাড়ির লোকজন বলে দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে তার বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দেবে।
"কলেজে এডমিট কার্ড তুলতে হবে"
...এই বলে, বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে দুই সপ্তাহের বন্দী জীবন থেকে অঞ্জনা সাময়িক মুক্তি পেল। কথা মত পুরুলিয়া সুভাষ পার্কে অবিকলের সাথে দেখা করে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলে, " তুমি কিছু একটা করো।জোর করে বাড়িতে এই মাসেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। শুনেছি আগামী কালকেই লোকজন ছেলের বাড়ি আশীর্বাদ করতে যাবে।"

অবিকল, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, " কি যে করতে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা- মা তোমাকে কিছুতেই মেনে নেবে না। তোমার ব্যাপারে বাবা একথায় না বলে দিয়েছে ।"
..."তবে কি হবে আমাদের!" অঞ্জনা উদাস ভাবে বলে।
অঞ্জনাকে বুকে টেনে, দুহাত দিয়ে চেপে ধরে, বলে," তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব হারাতে রাজি আছি।আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে জীবন দিয়ে হলেও আজ রক্ষা করব।"
অঞ্জনা, অবিকলের কোলে মাথা রেখে,চোখে চোখ রেখে,বলে ওঠে, "আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। বাড়িতে মার খেয়ে মরার চেয়ে তোমার কোলে মাথা রেখে মরায় শ্রেয়। "
.. অবিকল ,অঞ্জনার মাথার ঘন কালো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, " আমি বেঁচে থাকতে এমন কথা বলো না। আমি কিছু একটা বাঁচার উপায় বের করবই। "

অঞ্জনার এক বান্ধবী বছর খানেক আগে ভালোবেসর  কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি মেরেজ  করেছে। এখন বেশ সুখেই স্বামীকে নিয়ে ঘর করছে। অবিকলের সে কথা জানা ছিল,তাই অবিকল অঞ্জনার হাত ধরে,হাসি মুখে বলে,
বাড়িতে যখন কেউ আমাদের ভালোবাসার মূল্য দেবে না ।আমাদের বিয়ে দেবে না।" তখন চলো। আমরা তোমার বান্ধবীর মতো কোর্টেই গিয়ে বিয়েটা করি।"
আনন্দে অঞ্জনা অবিকলকে বুকে জড়িয়ে ধরে জীবন সমুদ্র পড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।....


.........সমাপ্তি..........


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন