শুক্রবার, ৩১ জুলাই, ২০২০

গণতন্ত্র


গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক!
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে সোয়ারী দুর্নীতিপরায়ণ দলতন্ত্র।
রথে চলেছে গুটিকয়ের সমাজবিরোধী,গরু ,গাধা!
গণতন্ত্র? কিসের গণতন্ত্র? কাদের গণতন্ত্র?
না। গণতন্ত্র আর এদেশে নেই।
গুন্ডাতন্ত্রের হাতেই এখন গণতন্ত্র বাঁধা।

ভোটের নামে চলছে লুটপাট,বছর বছর ধরে,
'জোর যার মুলক তার' ....
এটাই এখন দেশের গণতন্ত্র।

ভোট এখন মহোৎসব! মহান গণতন্ত্রের মেলা।
আদা জল খেয়ে নেমে নেতারা,
পায়ে ধরতেও করেনা অবহেলা।
একবার যদি নির্বাচনে জিতে যায় সেই নেতা,
আগামী পাঁচ বছর দেখাবে ,
হরির লুট, শোষণ করার নিত্য নতুন খেলা।

গণতন্ত্র এখন শিল্পপতিদের বুক পকেটে বন্দি।
বেঈমান, নেতা,মন্ত্রীরা গোপনে গোপনে,
জনগণকে ধোকা দিয়ে,কোটি কোটি কালো টাকায়
গণতন্ত্রকে বেচে দিয়েই দুর্নীতির সাথে করছে সন্ধি।

ধর্মের দগ দগে আগুনে



আধুনিক যুগের ধর্ম এই,
যারা একমুঠো পচা,বাসি খাবারের তরে
মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে 
তবুও জোটে না খাদ্য,
আর যারা চাই না কোনদিনও খেতে 
তাদেরকে আমরা দিচ্ছি যেচে,
অভুক্তকে বঞ্চিত করে সাজাইছি নৈবদ্য।

হায় রে,আমরা কেমন এ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীব!
চোখের সামনে ছটপট করতে করতে
না খেয়ে কোলের শিশুটি মরছে,
গুজবের জেরে রক্ত ঝরছে,
ধর্মের রক্তক্ষয়ী হানাহানি,
সুযোগসন্ধানী ধর্মান্ধররা,
কেউ ত্রিশুলে,কেউ চাপাতিঘাতে চালায় কুরবানি।

ধর্মের বিষবাষ্প যখন ছেয়েছে সারা দেশ,
মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হবে কি?
দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যাভাষণে,
তোষণ নীতি, আর হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন
ধর্মের দগদগে আগুনে তারা ঢালছে ঘি।

ধার্মিক vs অধার্মিক



ধার্মিকের চেয়ে অধার্মিক শতগুনে ভালো। 
অন্ধকার দূর করে তারাই এনেছে আলো।।

জগতের যা ভালো সৃষ্টি ,অধার্মিকের দান।
মারামারি,কাটাকাটি ধার্মিকদের  অবদান।।

মন্দির গড়ে ধার্মিক, মন্দির ভাঙে ধার্মিক।
মসজিদ গড়ে ধার্মিক,মসজিদ ভাঙে ধার্মিক।।

তবুও ধার্মিকরাই সমাজের চোখে,হিরো- মহান।
মারামারি, ভাঙ্গভঙ্গিতে নেই,তারাই বেঈমান।।

ধর্মই মানুষকে উঁচুজাত নিচুজাতে ভাগ করে।
ধর্মের কারণেই দেখ,হাজার হাজার মানুষ মরে।।

দাঙ্গাবাজ দাঙ্গা করে,নিজের ধর্ম করে চাঙ্গা।
লাশের উপর রাজনীতি, পকেট ভরে রাঙ্গা।

ধর্মের আফিম যে খেয়েছে,সেই বনেছে ভেড়া।
কেউ দাড়ি,কেউ টিকি, কেউ হয়েছে ন্যাড়া।।

সোনার সন্ধান



জনগণের রক্ত চুষে,  জন্মেছে আগাছা, 
   গোবরজীবি অকালকুষ্মাণ্ড তারা।
         হেসো না,  বন্ধু----
                গোবরে যায় দেশপ্রেমিক চেনা।
রণে ,বনে ,জলে জঙ্গলে
  কোথাও যদি গোবরের পাও সন্ধান,
       উল্টে পাল্টে দেখ বারবার,
            ভাগ্য দেবী যদি প্রসন্ন থাকে, 
                  মিললে মিলতেও পারে সোনা।

গোবরের যে কি গুণ ?
     কি করে বোঝাব তোমায়? 
কলগেট ব্রাশ ছুঁড়ে ফেলে দাও ডাস্টবিনে,
    সকাল বিকাল গোবরে দাঁত মাজো,
       অনেক উপকার আছে তাতে, 
এইমাত্র একবন্ধু সুখবরটা দিলো আমায় ।

আসুন,  দুই হাত তুলে কীর্তন করি,
    গাহি গো মূত্রের গুণগান, 
         ভারত আবার নোবেল প্রাইজ পাবে,
            
  গো মূত্রে পেয়েছে সোনার সন্ধান।
মেয়েদের মুখে হাসিখুশি ভাব ,
    যাক্ এবার বাঁচা গেল, 
         কমবে অলঙ্কারের চড়া দাম ।
গোবরজীবি গো বিজ্ঞানীরা অমর, 
    ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে
        লিখা থাকবে তাদের নাম(?)


ধর্ম আর রাজনীতি


ধর্মের মধ্যে রাজনীতি আছে,
      রাজনীতির মাঝে আবার ধর্ম,
গরীবের মাথায় হাত বুলানো 
    দেশের নেতাদের এখন কর্ম।

যারা যত বড় অপরাধী, 
      তারাই আজ তত বড় মন্ত্রী ।
সারা দেশে একই চিত্র ,
    আছে দুই, একটি  ব্যতিক্রমী ।

মানুষ গুলো কে পশু বানালে
    তবেই করা যায় পশুর কাজ ।
গরীবের বুকের রক্ত নিংড়ে নিয়ে
    গড়ে উঠেছে নেতাদের  রাজ প্রাসাদ ।

ধর্ম আর রাজনীতি এখন
      একই মুদ্রার এপিঠ,ওপিঠ 
সারা বিশ্বে অশান্তির কারণ 
     ধর্মই   যুগে যুগে করে মারপিট।

নির্বাচন ভাই, টাকার খেলা,
    নেতাদের প্রহসন মাত্র।
শিল্পপতিরা শিক্ষক মশাই,
     নেতারা হলো অনুগত ছাত্র ।

ধর্ম আর রাজনীতি এখন
      একে অপরের সহোদর ভাই, 
এমন হীন কর্ম বাকি নেই, 
      যা ধর্ম ও রাজনীতিতে হয় নাই ।

নেতারা চাই না, শিক্ষিত সমাজ
   চাই না, জন সাধারণের ভালো।
ধর্মের অন্ধকারে ডুবে থাকুক, 
      না, জ্বলুক শিক্ষার আলো ।

ধর্ম, রাজনীতি আর দুর্নীতি
     মিলে মিশে আজ একাকার ।
শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত মানুষের
  শোনা যায়, বিশ্বময় হাহাকার ।

কবিতা আক্রান্ত


মহান কবিতা দিবসে কবিতা আক্রান্ত ,
   কবি শ্রীজাত এর হলো এফ. আই. আর।
    তোমরা কি সখের কবি ?
           হাত গুটিয়ে বসে আছ ।
এখনই জানাও কবিতার তীব্র প্রতিবাদ ।
       কলম চুষে চুষে ভাবছ ,ভালোই আছি, 
বন্ধু,  এরকম হতে পারে তোমার - আমার ।
'সাহিত্য যদি সমাজের দর্পণ'
    সমাজের প্রতিচ্ছবি তাতে ধরা পড়বেই ।
           ধর্মের কদর্য রূপ কেন বাদ যাবে ?
কবি তুমি কি কাপুরুষদের ভয়ে ভীত ?
     লিখে যাও ঘুন ধরা সমাজের
            অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি সত্য আছে যত ।

এই নপুংসকের দল শক্তিশালী সূর্যকে
        আবার কি পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরাবে?
মানব সভ্যতার ইতিহাসের চাকাকে,
    এরা নিয়ে যেতে চাই,আদিম যুগের পশুস্তরে।

এই কাপুরুষদের জন্য আমরা হারিয়েছি, 
মহান বিজ্ঞানী গ্যালিলিও, কোপার নিকাস
এখনই সময় বুঝে নাও, পুরনো সব হিসাব ।
হাজার কলম একসাথে  গর্জে উঠলে তবে,
 কাপুরুষের দল পালাবে লেজ গুটিয়ে সবে।

22 / 03 / 2017

আমার ধর্ম মানবতা



আমি মানুষ, আমার ধর্ম মানবতা, 
   ----এটাই হোক সমস্ত মানুষের পরিচয়, 
   হিংসা, বিদ্বেষ, খুন ,সন্ত্রাস
      ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, কাটাকাটি
         ধ্বংসাত্মক  দাঙ্গা, কখনোই কাম্য নয় ।

আমার বাংলা, সোনার বাংলা, 
    যে মাটিতে জন্মেছে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ।
       সেই সোনার বাঙালার মাটিতে হিংসার আগুন,
           দাঙ্গাবাজেরা মানুষকে বোঝায় সবসময়ই ভুল।

চেয়ে দেখ রে কুলাঙ্গার  দাঙ্গাবাজেরা,
   মানুষই উপড়ে ফেলবে তোদের ঐ বিষ নখ দাঁত ।
একত্রিত শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষেরা
     আজ মিলিয়েছে পরস্পরে হাত।

ধর্মের নামে সংকীর্ণতার রাজনীতি, 
    সমাজের বিষবাষ্পের ফল, 
      সচেতন মানুষই একদিন
          ধর্মকে ছুঁড়ে ফেলে করবে বিকল।

এসো, সবাই আজ শপথ গ্রহণ করি,
   জাতি - ধর্ম, বর্ণ সব ভুলে, 
     এই সোনার বাংলায় থাকবো মোরা,
      ভাইয়ের মতো পাশাপাশি মিলে ।

07 / 07 / 2017

ধর্ম নিরপেক্ষতা


ধর্ম নিরপেক্ষতার বৃক্ষটি 
আজ বড়ই নড়বড়ে।
গুটি কয়েক নেংটি ইদুর
 রাত দিন জাগ্রত, 
নব কিশলয়ে বসন্ত আসে না, 
দু চোখে স্বার্থপর ঠুলি।
বন্যায় দুকূল ছাপিয়ে গেছে
প্রান পনে দিই বলির বাঁধ।
বুনো জলের তোড়ে
ধর্ম নিরপেক্ষতা আজ অসহায়।

ধর্ম বড়ো নই রে ভাই


বাংলার হিন্দু মুসলমানের ইতিহাস,
   আবারও কলঙ্কিত করল কারা? 
     কারা ছড়াল হিংসার আগুন? 
        সমাজ সচেতন মানুষ গুলো,
           এবার দাঙ্গাবাজদের চিনুন ।

স্বার্থানেষী রাজনৈতিক নেতারা
  হিন্দু, মুসলমানে ভুল বুঝিয়ে, 
     মনে প্রানে ধরায়, বিশ্বাসের ফাটল ।
হাজার বছরের ঐতিহ্যকে,
    দু পায়ে মাড়িয়ে দিয়ে দেখায়, 
      উগ্র ধার্মিকতার ভয়ঙ্কর দাপট ।

বিভেদকামীরা যতই হুঙ্কার ছেড়ে গর্জায় না কেন, 
  সমাজের বুকে মারুক বিষবাষ্পের ছোবল ।
সম্মিলিত প্রতিরোধ রুখে দিতে পারে, 
      কু চক্রীদের ঐ অপচেষ্টা-----
         হিন্দু মুসলমান আবারও সেই কাজে সফল ।

সাধারণ মানুষ দাঙ্গা চাই না, 
   চাই ক্ষুধার্ত পেটে এক মুঠো ভাত, 
ভাত দেওয়া তো দূরের কথা, 
   ধর্মের নামে রাজনীতি করে, 
       দেশের রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রীরা
       গরীবের ক্ষুধার্ত বুকে মারে আঘাত ।

ধর্ম বড়ো নই রে ভাই, 
    মানুষই বড়ো জগৎ মাঝে, 
       বিভেদের কৃত্রিম প্রাচীর গড়তে, 
             নেতারা নিত্য নতুন ফন্দি খোঁজে ।

সাধারণ মানুষ সতর্ক হোন, 
    এই ধর্ম ব্যবসায়ীদের কবল থেকে ।
পারমানবিক বোমার চেয়েও 
    এরা মারাত্মক ভয়ংকর ।
       সবসময়ই দূরত্ব বজায় রাখুন,
         এদের কাণ্ড কারখানা থেকে ।

ধর্মভীরু সমাজ



মানুষের অজ্ঞতার গর্ভেই জন্মে,
ছোট, বড়ো, মাঝারি মাপের
গুরুবাবা,যুগপোযোগী অবতার।
এরা বহুরুপীর মতো রং পাল্টে,
কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ  করে,
সুযোগসন্ধানী, ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ  সম,
সাজানো সুন্দর সমাজ এরা করে ছারখার।

কুসংস্কারাছন্ন, পঙ্কিলময়,জীবনপথে,
সমস্যাবহুল এই উর্বর সমাজে,
কর্মফল, গ্রহদোষ, জন্মান্তরবাদ স্তুপাকারে,
ধর্মভীরু  মানুষজন এদের সহজলভ্য শিকারে,
শাঁখেরকরাতের  লাভজনক ব্যবসায়,
শুধুমাত্র  মাথায় হাত বুলিয়েই তারা,
কোটি কোটি টাকা জমায় ব্যাঙ্কের ঘরে।

ধর্ষনে অভিযুক্ত, যত বাবা নামধারী,
বহু কুকর্মের সাথী,আপাদমস্তক  ভন্ড,
তবুও সমাজের চোখে পায়  সন্মান।
ধন্যি আমরা! ধন্য আমাদের সমাজ!
ধর্মভীরু  মানুষের চোখে তারা, হিরো,
ইহ জগতের তারা, মূর্তিমান  ভগবান। 

যারা নিজের উপরে বিশ্বাস  হারায়,
হাতে,গলায়, কোমরে,লাল,নীল সুতো জড়ায়,
মাদুলী, কবজ, তাবিজ শরীরে করে ধারন,
তারা জানে না.....
অলৌকিকত্ব  বলে কিছু নেই,
সমাজে যা ঘটে, সবই লৌকিক,
তবুও অলীক আশায়,ভরা সংসারে,
ওঝা,গুনিন, তান্ত্রিক, জ্যোতিষরা.....
ভগবান সেজে,করে ভাগ্য নির্ধারণ।

অজ্ঞতার নাগপাশ ছিন্ন করে,
জেগে ওঠো,ধর্মভীরু  সমাজ,
মুক্তচিন্তার মশালকে ব্জ্রমুষ্টিতে ধরে,
সামনের দিকে এগিতে চলো,
ভয় নাই, ওরে ভয় নাই.....
জড়তা কাটিয়ে,কুসংস্কারকে লাথি মেরে,
জেগে উঠবে আবার ধর্মভীরু  সমাজ।

মুখোশের আড়লে 
কঠিন সংকটের মুখোমুখি আমারা
     আকাশে বাতাসে শোনা যায় নতুন সমাচার, 
   রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষায় আছি তবু,
       চারদিকে ঘনিয়ে আসছে অন্ধকার ।

মানব সভ্যতাকে গলা টিপে হত্যা করে,
      চলছে ধর্মের তান্ডব নৃত্য, 
  ভোরের ঝরে পড়া শিউলি ফুলে, 
      লেগে আছে তাজা তাজা রক্ত ।

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশে,
      এ কেমন কথা যোগী পুরুষের মুখে? 
  কবরে গেলেও রক্ষা নেই নারীর, 
     মৃতদেহ তুলেই ধর্ষন করো তাকে ।

নারী যদি মা হয়,  মা হয় দেশ, 
      তাকেই করবে ধর্ষন ? এই তুমি যোগী? 
  নর পিশাচ ,লকলক করে জিহ্বা, 
     যোগীর মুখোশের আড়ালে,  আসলে তুমি ভোগী ।

যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই


যুদ্ধ চাই না,শান্তিই চাই,
যুদ্ধের বিভীষিকাময়  পরিণতি 
সজ্ঞানে জেনে বুঝেও
যুদ্ধ, যুদ্ধ, মারণযজ্ঞ শুরু হয়।
কোটি কোটি  নিরন্ন মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে
রক্তের হোলী খেলায় মেতে ওঠে----
পৈশাচিক আনন্দে স্বার্থান্বেষী রাজনীতি।
কেনা হয় -------ব্রক্ষ্মাস্ত্র,মারণাস্ত্র,
মানুষের মঙ্গল কামনায়!
মানুষকেই মারার জন্য।
যুদ্ধ মানবতার বিরোধী
তাই,যুদ্ধের মারণযজ্ঞ  বন্ধ হোক।
যুদ্ধবাজরা নিপাত যাক।
যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই।

ধর্মের নামে ভন্ডামি



ধর্মের বেড়াজালে বন্দী আমরা
কোনো অদৃশ্য শক্তির কাছে হাত,পা বাঁধা,
লোভের বশে,মানবতার গায়ে ছুঁড়ছি কাদা।

চোখের পর্দা খুলে দেখো,সকল বন্ধু, বান্ধব,স্বজন,
ধর্মের নামাবলী জড়িয়ে সর্বাঙ্গে,
যত স্বার্থান্বেষী  মানুষের দল,
দিনের মাঝে ডাকাতি করেই,
তাদের পাহাড় প্রমান জমেছে ধন সম্পদ।
ঈশ্বরাদেশ, ধর্মের নামে চলে মুনাফা অর্জন।

ছিঃ  লজ্জা করে না তোমাদের,
'জীবকে ঠকিয়ে শিব সেবা'-----
মনুষ্যত্বহীন, বিবেকও দিয়েছ বিসর্জন!
কুসংস্কারে নিক্ষেপ করে মিটাও---
তোমার অতৃপ্ত টাকার পিপাসিত  মন।
শুন ভাই,
মোল্লা,পান্ডা,পুরুতঠাকুর আর কাজী,
জগতের যতসব সুবিধাভোগী দল,
মানুষে সাথে মানুষে ভুল বুঝিয়ে,
কৃত্রিমভাবে বিভেদের প্রাচীর  তুলে,
'মাছ ধরতে নামে ঘোলা জলে'------
তারা ধর্মের ষাঁড়,মানবতাকে পাশ কাটিয়ে চলে।

ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে,"পেটপূজা"
বিশ্বের কোন ধর্মের কথা?
ভেবে দেখেছ কি বন্ধু___
জন্ম থেকে মৃত্যু,এদের পঞ্জিকাতে আছে লিখা।

ঘন দুর্যোগকালের মুখোমুখি আমরা,
তারই অশনিসংকেত  মারছে উঁকি,
ধর্মকে জড়িয়ে ধরে, অর্থ পিশাচের দল,
উচ্চস্বরে চীৎকারে করছে রেষারেষি।
ধর্ম ব্যবসাই  বড়ো ব্যবসা ভাই,
প্রকাশ্যে,অপ্রকাশ্যে,চলে খুন,ধর্ষন,কাটাকাটি।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা,
এখন মানব সভ্যতার বিপরীতে হাঁটি

পূজো আসছে



পূজো আসছে,পূজো আসছে,
    আনন্দের সীমা আর নাই,
     কেউ কি ভেবে দেখি?
যাদের একমুটো চালের জন্য,
উনুনের হাঁড়ির জল শুঁকিয়ে যায়,
  কত মানুষ অভুক্ত থাকে ?
      নিরম্বু  উপবাসে দিন কাটায় ?

যারা শরীরের রক্ত জল করে,
     মাঠে সোনার ফসল ফলায়,
         তবু দিনে একপেট খাওয়ার জোটে না।
পুজোর আনন্দ তাদের স্বপ্ন,বিলাসিতা মাত্র,
এদের কথা আমরা কেউ ভাবি না।
             আমরা এতোই নির্দয়!
পূজোর আনন্দে সবাই মাতোহারা,
  তাদের দু:খে কাঁদে না মোদের  হৃদয়।

আমরা মানুষ, তারাও মানুষ,
   রক্ত, মাংসে গড়া  একই শরীর,
পূজোর আনন্দে আমরা
  হাজার,হাজার টাকা উড়িয়ে দিই।
     তবুও কোনদিন  দিইনি তাদের হাতে
         আমার পকেটের একটিও  টাকা।
নতুন নতুন জামা কাপড়ে
   আমাদের ঘর ভরে যায়,
কিন্তু  তাদের লজ্জা নিবারনের
            ছেঁড়া কাপড় টুকুও জোটে নাই।
অনাবৃত,কঙ্কালসার শরীরটা
থাকে না ,পূজোর আনন্দের দিনেও ঢাকা।

দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে


তুমি মানো আর না মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।
দেশপ্রেমে উত্তপ্ত নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু,
আকাশে, বাতাসে,ছড়িয়েছে তার ধ্বংসাত্মক পরমানু।
কে দেশপ্রেমিক?
আর কেই বা দেশদ্রোহী?
আজ বিচারে নেমেছে কারা?
যারা স্বার্থান্বেষী, ধর্মান্ধ, দুর্নীতির পঙ্কিলে আকন্ঠ নিমজ্জমান,
দেশ জুড়ে চলতে থাকে নিত্য নতুন ফরমান।
উতলা হাওয়ার ঝড় ঝাঁপটে,উদ্দমতার বসে
হাজার হাজার নারী ও শিশুর প্রান পাখি পড়ে  খসে,
----এই দেখে মহান মহান রাজনৈতিক নেতারা বলে,
'এটা একটা ছোট্টখাট্টো ঘটনা'
এতো বড়ো দেশে এরকম দু একটা ঘটে.....
তুমি মানো আর নাই মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।

দুর্নীতি যে দেশে আকাশ চুম্বী,
অন্যায়ের সাথে আপোষ না করে 
এক সেকেন্ডও বেঁচে থাকা যায় না।
সে দেশে কার আছে বুকের পাঁটা?
যে নির্ভীক কন্ঠে বলে সত্য কথা!
সত্য জাহির যতই কর তুমি
যুক্তিতর্ক আর গুগল নেট ঘেঁটে,
রাষ্ট্র শক্তি মোটেই ভীত নয়!
মাওবাদী ছাপ মেরে,বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে
এক মুহূর্তেই নিবে আপনার মাথা কেটে.....
তুমি মানো আর নাই মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকইই বটে।

যে দেশে বেঁচে থাকার অধিকার নাই
নেই খাদ্য,শিক্ষা,স্বাস্থের  চিকিৎসা....
সর্বোপরি  বাক্ স্বাধীনতার অধিকার,
গণতন্ত্র  আছে শুধু মুখের কথায়,
আর আছে সংবিধানের শুকনো পাতায়।
বাস্তবের মাটিতে নেই গনতন্ত্রের ছিঁটে ফোটা!
দেশের টাটা -বিড়লা -আম্বানিদের সাথে 
কালাহান্ডির কঙ্কালসার মানুষ গুলো
কি সমান অধিকার ভোগ করে?
দিনের পর দিন অনাহারে অভুক্ত থেকে
খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যু মিছিল ঘটে...
তুমি মানো আর নাই মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।

দেশের সংবিধান মতে.....
প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি  আর নেতা মন্ত্রীর
পাশাপাশি  গ্রামের ভিখারিনী  দুখি
সমান সমান অধিকার পাই,
কিন্তু বাস্তবে অধিকারের চিহ্নমাত্র নাই!
গরিবের অধিকার আজ নেতা মন্ত্রীরা নিছে চুষে,
শোষকের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে দেখ,
সরকার  সংগঠিত গুন্ডা বাহিনী রাখে পুষে।
কখনো শুনতে রাজি নয়,বিরুদ্ধ স্বর
নেতা মন্ত্রী রা আজ হয়েছে নরাধম।
দেখ,শোষনের শিকার আপামরজনসাধারণ, 
তাদের একটাই পরিচয় কুলি মজুর মুটে......
তুমি মানো আর নাই মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।

যুদ্ধ যারা করে না ভাই
যুদ্ধ খেলায় তারাই নামতে চাই।
 যারা সৈনিক, যুদ্ধের ময়দানে লড়ে
তারা কি স্বেচ্ছায় মারণযজ্ঞে মরে!
শিল্পপতিরা সরকারকে যেভাবে নাচাই
নেতা মন্ত্রিরা লেজ নেড়ে সেভাবেই নাচে।
এমন আন্দোলন করা যাবেক নাই,
যাতে প্রাণপ্রিয় ধনকুবেররা যায় চটে...
তুমি মানো আর নাই মানো হে
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।
কোনোকথা মিথ্যে বলিনি ভাই
খেটে খাওয়া শ্রমজীবী, সংখ্যাগুরু জনগনের সাথে,
নেতা মন্ত্রি,শিল্পপতি দের ধনদৌলত
আকাশপাতাল  অসাম্যের ব্যবধান প্রতি মুহূর্তে ঘটে...
তুমি মানো আর নাই মানো হে...
দেশটা আমাদের গণতান্ত্রিকই বটে।
০১/০৩/২০১৭

সৎ পথে চলা


সত্যি কথা বলা,  আর সৎ পথে চলা, 
কখনই নিষ্কণ্টক নয়।
দুর্গম গিরি, বন্ধুর পথ, 
মিথ্যাচার, সত্যের অপলাপ,  
ধর্মের ষাঁড়দের চোখ রাঙানো, 
নির্ভীক সত্য সন্ধানীরা সর্বদাই পথভ্রষ্ট হয়।

ধর্মের মায়াজাল, কর্মদোষের ভয়ঙ্কর ফল, 
মানুষকে অষ্টে পৃষ্টে বাঁধতে চাই, 
জন্মান্তরবাদ নামক লোভীদের বানানো মিথ্যে কল।
আরো কত আছে সমাজে পথপ্রদর্শক ,
গুরুবাবা,পিরবাবা, নানা বাবা অভিধায়।
যারা স্বঘোষিত, স্বমহিমায় বিরাজমান ।
অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে, 
ধর্ম ভীরু মানুষকে করে নানা ফরমান। 

গুরু বাক্য সুবাক্য, কুবাক্য নয়, 
গুরুবাদের পাতা ফাঁদে ,
গরীব মানুষগুলো সর্বশান্তই হয়।

সত্যি কথা বললে পরে, 
এখন আবার শত্রু বৃদ্ধি পায়, 
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারে,
এমন নির্ভীক বুকের পাটা নাই।
সত্যি কথা বলা, আর সৎ পথে চলা, 
জীবনের  সবচেয়ে জটিলতম কাজ, 
"যে দেশে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী,সর্বব্যাপী, 
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির বাস"...
সে দেশে সৎ পথে চলা, বড়ই কঠিন কাজ। 

মানুষ এখন আর মানুষ নয়



মানুষ এখন আর মানুষ নয়, 
ধর্মের বিষাক্ত গ্যাসে নিমজ্জমান, 
বিবেক ,বুদ্ধি, বন্দী হয়ে আছে, 
মৌলবাদী পাষণ্ডদের মুষ্টিমেয় হাতে।
মানবতা ধর্ষিতা হতে হতে
মানুষ হারিয়ে ফেলে অর্জিত  মান, অপমান ,সন্মান।
অভ্রভেদী হুঙ্কারে কম্পিত ধরণীতল, 
অস্ত্রের বিদ্যুৎ ঝলকানি ইঙ্গিত পাঠায়, 
মানুষ এখন আর মানুষ নয়, 
আমার এখন ধর্মের অন্ধভক্ত দল।

আমরা তুলছি, ধর্মের বিজয় কেতন, 
বিধর্মীদের মুণ্ডুহীন নিথর দেহে,
বিশ্ববাসীকে প্রকাশ্যেই দেখিয়ে দিই, 
 আমাদের দেশ কুসংস্কারে কতটা এগিয়ে।
মানুষ এখন আর মানুষ নয়, 
চাপা পড়ে গেছে, 
ধর্মের গোলকধাঁধার যাঁতাকলে।

উগ্র মৌলবাদী ধর্মীয় সংগঠনের ভয়ে, 
মানবাধিকার কর্পূরের মতো উবে যায়, 
চুপিচুপি, চার দেওয়ালের অন্ধকারে।
কাল নাগিনীর লিক, লিক জিহ্বা, 
নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে তাজা বিষ ঢালে,
বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে, 
এক এক করে মানুষ মরে।

ধর্ম এখন হিংসা, বিদ্বেষ,গন উদ্দামতা, 
সন্তানের লাশ দেখে কাঁদে অসহায় মাতা।
মানুষের কান্ডকারখানা দেখে,
এখন বনের পশুর  হাসি পায়, 
ভাবে--এই মানুষগুলো আবার পশুর দলেই ফিরবে, 
সে দিন আর বেশী দূরে নাই।

যুবসমাজ



একবিংশ শতাব্দীর যুব সমাজ মেরুদণ্ডহীন,দুর্বল,
প্রতিবাদহীনতায়,ভেঙেছে তাদের যুগ যুগান্তরের সঞ্চিত মনোবল।
সাম্প্রদায়িক  বিষবাষ্পে,পৃথিবী  দিশাহারা,
দ্রুত থেকে দ্রুততম বেগে ধাবিত,
হিংসার লেলিহান শিখা।
বিশ্বের কেউই আজ আর সুরক্ষিত নয়,
ক্রমবর্ধমান বাক্ স্বাধীনতার কণ্ঠরোধে__
সবাই  ভীত, সন্ত্রস্ত, 
ঘোষিত মানবতাবাদীরাও বর্তমানে বাক্ হারা।
প্রাণ চঞ্চল যুব সমাজ তবে কি নীরব দর্শক?
না, তা হয়তো নয়..
বহু দলে আজ তারা ছন্নছাড়া।

পৃথিবীর কোনায় কোনায় দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে
পৌঁছে গেছে উগ্রবাদের রণংদেহি হুংকার।
দৈনিক খবরের কাগজে,টিভির পর্দায়,
এখন চোখ রাখলেই শোনা যায়,
অসহায় মানুষের গগনস্পর্শী বুকফাটা  করুণ আর্তনাদ।

ধর্মের জন্য, কল্পিত প্যুণ্যফলের আশায়,
কত প্রানচঞ্চল, তরুণ তরুণী,
না বুঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে,
ধর্মের ষাঁড়েদের পাতা  ফাঁদে।
হাজার হাজার কুকর্ম করেও
তারা স্বর্গে যাওয়ার জন্য অঝোরে কাঁদে।
হায় রে দেশের যুব সমাজ!
অসীম নীল মত্ততার টানে ,বিকৃতরুচির  উত্থানে,
ক্রমশ অবক্ষয়িত  যুব সমাজ।
যারা গোটা পৃথিবীকে উল্টে পাল্টে,
দেওয়ার অসীম ক্ষমতা রাখে,
তারা কেন আজ ভয়ে কাঁপে?
এই যুব সমাজের দুর্দশা  দেখে,
বসুন্ধরাও  আজ নীরবে কাঁদে।

এ যুব সসমাজের ঘুম ভাঙবে  আর কবে?
তারা খুলে ফেলবে কবে নিজেট চোখের ঠুলি?
অদৃশ্য বিভেদের মায়াজাল  ছিন্ন করে,
মানুষের সাথে মানুষের হবে কি কোলাকুলি?
এ ধরাতে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই শ্রেষ্ঠ নয়,
আমরা সবাই মানুষ....
এটাই হোক আমাদের একমাত্র পরিচয়।
                                                                        ১৪/০৯/২০১৭

বৃহস্পতিবার, ৩০ জুলাই, ২০২০

সোনালীর বিয়ে

মহা ধুমধামের সহিত, সমস্ত ঘর- বাড়ি- উঠোন, পাড়ার রাস্তা, আলোয় আলোকিত করে,কোন রকম ঝুট- ঝামেলা ছাড়াই সোনালীর বিয়েটা ভালই ভালোই মিটে গেল। সোনালী এমনি ধুমধাম করেই তো একদিন বিয়ে করতে চেয়েছিল !  ইচ্ছে হলেই তো আর সকল সেই ইচ্ছে পূরণ হয় না। তবে সোনালীর এই ধুমধাম করে বিয়ে করার ইচ্ছাটা এতদিনে পূর্ণ হল । সোনালীর বাবা একজন সামান্য ব্যাংক কর্মচারী। তাই মাস মাইনের বেতনটাও সামান্যই। তবুও মেয়ের মুখে হাসি ফোটাতে তিনি বিয়েতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেনি। সোনালী-ই তার বাবা মায়ের একমাত্র কন্যা। বাবা-মা বিস্তর দেখাশোনা করে সুপাত্রে তাদর আদরের কন্যাকে সমর্পণ করে ।পাত্রটিও মন্দ নয়। দেখতে শুনতে ভাল। সরকারী না হলেও বেসরকারী চাকুরে। তাতে কি! 
ভালো অঙ্কের মাস মাইনে তো আছে। তাছাড়া পাত্রের বাবার সাথে সোনালীর বাবার কিছুটা পরিচয় আগের থেকেই গড়ে উঠে।
তারা দুজনেই সাদাসিদে ভদ্রলোক। দুজনেই ব্যাংক কর্মচারী। তারপর দুজনের মেদিনীপুরেই তাদের চাকুরীস্থল ।তাই ভরসা করেই তিনি পুরনো দিনের বন্ধুর একমাত্র ছেলে অভিজিৎ এর হাতে নিজের আদরের একমাত্র কন্যা সোনালীকে তুলে দেই। যদিও এ বিয়েতে সোনালীর মতামত নেওয়া হয় নি ।সে বিয়েতে কিছুতেই রাজি ছিল না। কিন্তু মেয়ের মতামতে কিবা আসে যায়! মেয়ে মানুষ! পরিবারের কাছে শেষ পর্যন্ত সোনালী নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
যাইহোক বিয়ের পরেই সোনালী বরের সাথে কলকাতার ফ্লেটে চলে যায়। সোনালী গ্রাম্য মেয়ে। শহরের আদব-কায়দা রীতি-নীতি সবকিছু ঠিকমতো রপ্ত করে উঠতে পারেনি। কলকাতার মতো ব্যস্ত রাস্তায় সোনালী কোনদিন হাঁটে নি। বিয়ের আগে কোনদিন ফ্লাটে থাকেও নি।তাই বলে কি সে ঘর সংসার ছেড়ে পালিয়ে আসবে? না ,তা বোধ হয় আর কোনোদিনই সোনালীর পক্ষে সম্ভব হবে না।

নীল আকাশের মুক্ত বিহঙ্গ কে বাড়ির খাঁচায় বন্দী করলে পাখির যে অবস্থা হয়, সোনালী অবস্থাটা অনেকটা সে রকম। গ্রামে তার অবাধ স্বাধীনতা ছিল। পাড়া-প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধবিদের বাড়ি আনাগোনা। অফুরন্ত সুযোগ। কলকাতায় এখনো তার কোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয়-স্বজন গড়ে ওঠেনি। যদিও সোনালীর বর অভিজিৎ মন্ডল খুব ভালো মানুষ। অফিস টাইম বাদে বাকি সময়টুকু সোনালীর সাথেই কাটান। তবুও সোনালীর মন পড়ে থাকে সেই গ্রামেই।হবেই না কেন! গ্রামের সাথে তার নাড়ির যোগ । এটা তো আর কেউ-ই অস্বীকার করতে পারবে না। তাছাড়া সাদা কাগজে দাগ লাগলে যেমন সহজে যায় না, তেমনি প্রথম প্রেমও সাদা কাগজের দাগের মতোই মন থেকে সহজেই মুছে ফেলা যায় না।

ঠাকুর যেমন সমস্ত মনোযোগ দিয়ে মাটির মূর্তি গড়ে, তেমনি পৃথিবীর সমস্ত রূপ তিল তিল করে আহরন করে স্রষ্টা সোনালীকে অপরূপ সুন্দরী করে গড়ে তুলেছে। দুধে আলতা রাঙা গায়ের বর্ন। দেখতে রূপকথার পরীর মতো।বাংলা সাহিত্যের আদি যুগে, বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন " চর্যাপদ" এ কোনো লেখকের লেখা থেকে জানা যায়, 'আপনা মাংসে হরিণা বৈরী।" তেমনি সোনালী অতি সুন্দরী মেয়ে হওয়ার জন্য, পাড়ার ছেলেদের লুব্ধ দৃষ্টি এড়িয়ে চলা খুব কঠিন। সবাই তাকে কাছে পেতে চাই। ভালোবাসতে চাই। আপন করে নিতে চাই। প্রেম করতে চাই। বন্য হরিণকে ধরতে সবাই যদি ফাঁদ পেতে বসে থাকে, থাকলে, হরিণ যতই চালাক, চতুর হোক না কেন, সেই হরিণ কারো না কারো পাতা ফাঁদে একদিন না একদিন পড়বেই। 
সোনালি ওই ভাবেই একদিন ধরা পড়েছে বিকাশের হাতে।
বিকাশ সোনালীদের পাড়ার ছেলে। পড়াশোনায় বেশ ভালো। গ্রামের সবাই তাকে চেনে, জানে।
                     *************(2)**************
সোনালী গ্রামের স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিনিয়ত ইচড়েপাকা ছেলেদের নানা অশালীন ইঙ্গিতপূর্ণবাক্য বাণের শিকার হয় । তবুও সাফল্যের সাথে মাধ্যমিক ,উচ্চ মাধ্যমিক রেজাল্ট করে ।গ্রামের নামো পাড়ার রথতলা পেরিয়ে পাশের গলিতে একটু গেলেই কোচিং সেন্টার। সেখানে সাপ্তাহে একদিন কোচিং হয়। কোনদিন সকালবেলা তো কোনদিন বিকালবেলা।সেদিন বিকালবেলা কোচিং যাওয়ার পথে কিছু ছেলে আবারও সোনালীকে অশোভন ইঙ্গিত করে।... সোনালীর কাছে এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয় ।প্রায় দিনই যাতায়াতের পথে তার সাথে ছেলেরা এরকম ব্যবহার করে। তবুও সোনালী তাদের পাত্তা দেয় নি।
কোচিং সেন্টারে পৌঁছে কিছুক্ষণ পরেই আকাশ কালো করে কালবৈশাখী ঝড় আসে ।ঝড় বৃষ্টি যেভাবে দুরন্ত বেগে এলো , সেভাবেই ঘন্টাখানেক তাণ্ডব চালিয়ে চলেও গেল। সাথে করে নিয়ে গেল ইলেকট্রিক কারেন্টটা । যখন কোচিং ক্লাস ছুটি হলো তখন পথে কালো কুচকুচে অন্ধকার। গাছের ঝরা পাতা পথের মাঝখানে কোথাও কোথাও স্তূপাকারে জমা হয়েছে। জমা হয়ে যাতায়াতে গতিপথ রুদ্ধ করছে।পথে কোন লোকজন নেই। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ।ব্যাঙের ডাক। গা ছমছম পরিবেশ। সোনালী অন্ধকারের বুক চিরে একটু জোর গতিতে পা ফেলছে । কোচিং সেন্টার থেকে সোনালীর বাড়ি বেশি দূরে নয় ।প্রায় এক কিলোমিটার মত হবে। তবুও হেঁটে হেঁটে মিনিট 10-15 মিনিট তো লাগবেই। কিন্তু রাস্তাটা আজ যেন শেষ হচ্ছে না।সাইকেলটি ঠেলে রথতলা পর্যন্ত এসে সোনালী থমকে দাঁড়ায়।
সামনে গোটা চারেক ইছড়ে পাকার দল। তারা মনে হয় ঝড় বৃষ্টির সময় রথতলাতেই ছিল।
হঠাৎ দলের একজন বাঘ যেমন হরিণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেভাবে সোনালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে , লোভাতুর দৃষ্টিতে চোখ পাকিয়ে বলে,...
"আজ শালিকে ছাড়ছি না।"
অপর দুজন সাথে সাথেই সোনালীকে ধরে টানতে টানতে বলে, 
"চল।চল, শালিকে নিয়ে চল।বহুত বাড় বেড়েছে। আজই সব মিটিয়ে দেব।"
টানাটানি করতেই সাইকেলের উপর সোনালী পড়ে যায় । তবুও অসম যুদ্ধে দুষ্কৃতি দের হাত কামড়ে, তীক্ষ্ণ নখের আঁচড়ে ওদের হাত থেকে মুক্তি পেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে। কিন্তু সে একা আর ওরা চার জন। সোনালি কি করে পেরে উঠবে?সোনালীর মান সম্মান ইজ্জত যখন মাটিটে মিশতে চলেছে সেই দুঃসময়ে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটে বিকাশের।সে সোনালীকে শ্লীলতাহানির হাত থেকে রক্ষা করে।

বিকাশ সোনালীর পূর্ব পরিচিত। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বিকাশ সোনালীকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সেসময় সোনালী তা প্রত্যাখ্যান করে।আর আজ বিকাশেই তাকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করে, ইচড়েপাকাদের মেরে,নাক ফাটিয়ে দেই। বিকাশ,একসময়ের ভালোবাসার পাত্রী সোনালীকে দুহাত ধরে তুলে বিনীত ভাবে বলে...
" চলো। তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিই।"
সোনালী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অফুস্ট স্বরে উত্তর দেয়।
"বিকাশ দা ।আমি একাই যেতে পারবো।তোমাকে আর যেতে হবে না।"

তবুও বিকাশ সে রাতে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেই।সোনালী বিকাশের উপর আগে যতটা ঘৃণা করত, সে দিনের ঘটনার পর ততটাই ভালোবাসতে শুরু করে।সেই দুঃসময়ে বিকাশ না থাকলে সোনালীর যে কি হতো! ...এটা ভাবলেই সোনালীর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খাড়া হয়ে ওঠে ।
গ্রীষ্মের দাবদাহের পর বৃষ্টির জল মাটিতে পড়লে মাটি যেমন সিক্ত হয়ে ওঠে, তেমনি বিকাশের স্নেহের স্পর্শে সোনালীর হৃদয়ও সিক্ত হয়ে ওঠে। 
সরস্বতী পুজোর দিন স্কুলের বাউন্ডারির আম গাছের ছায়ায় বসে প্রসাদ খেতে খেতে সোনালী বিকাশকে বলে, 
"তোমার এস এস সির খবর কি?
বিকাশ একটু কাচুমাচু করে বলে,
"টেট পরীক্ষায় পাস করে বসে আছি। সরকার রেজাল্টই দিচ্ছে না ।আশা করি এবারই আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। আর চাকরিতে জয়েন করেই ইয়ে, মানে তোমাকে লাল টুকটুকে বেনারসি পরিয়ে উলুধ্বনি বাজিয়ে আমার ঘরে নিয়ে যাব ।"
সোনালী বিকাশের পিঠে হাত রেখে একটু মিস্টি হেসে হেঁয়ালীর করে বলে, সাত মন ঘি হবেই, না, রাধা নাচেই হবে। আগে জয়েন্ট করো। তারপর......"

             ******************(3)******************

সরস্বতী পূজার পরের দিন বিকাল বেলা রান্না ঘরে, রাতের রুটি করার জন্য আটা মাখাতে মাখাতে সোনালীর মা সোনালির বাবাকে হঠাৎ ই বলে ওঠে ,
"সোনালীর বিয়ের ব্যাপারে কি কিছু ভাবছ! মেয়েটা যে দিনকে দিন তালগাছ হয়ে উঠছে গো।"
সোনালীর বাবা টিভিতে খবর শুনতে শুনতে বিজ্ঞ জনের মতো বলে, "কথাবার্তা চলছে। দেখি কি হয় ? বিয়ে তো দিতেই হবে ।আজ না হোক কাল।"
বাড়িতে বিয়ের কথা বার্তা উঠলে,কোন উপায় না দেখে,  অগত্যা সোনালী তাঁর মাকে চুপি চুপি বলে, 
" মা। আমি বিকাশকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে হলে ওকেই করব।"
সোনালীর মা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কোন বিকাশ রে?
.... "গ্রামের নামো পাড়ার বিকাশ!"সোনালী তাড়াতাড়ি উত্তর দেই।
সোনালীর কথা শুনে তার মা চুপ থাকে। কিছু বলে না।
সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া সমাপ্ত হলে সোনালী বিকাশের সাথে সম্পর্কের সবকিছু কথা মা- বাবাকে খুলে বলে। সমস্ত কথা শোনার পর তারা সোনালীর ভালো লাগা পাত্রের সাথেই বিয়ে দিতে রাজি হয়। সোনালীর কথা মতো ধুম ধাম করে বিয়ের আয়োজন করবে বলে কথা দেয়।এই শুনে সোনালীর আনন্দের আর কোনও সীমা থাকলো না! কিন্তু বাঁধ সাধলো তার মামা। সে যুক্তি দিয়ে বোঝালো,
"বিকাশ ছেলেটি ভালো তাতে কোন সন্দেহ নাই। সমস্যা হলো ছেলে এখনও বেকার ।কোন কাজ নেই। খাওয়াবে কি? পরাবে কি? তাছাড়া আগামী দিনে চাকরি পাবে তার কোন গ্যারান্টি নেই? বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে সোনালীর জীবনটা নষ্ট করো না।"


এর কয়েক দিন পরেই ঘটনার নাটকীয় মোড় পরিবর্তন হয়। এক শুভ লগ্নে বিকাশকে বাদ দিয়েই অভিজিৎ মন্ডলের সাথে সোনালীর বিয়ের পাকা কথা হয়।



ঠোঁটের কোণে সেই মিষ্টি হাসিটা

এই কিছুদিন হলো লালগড়ের এক বেসরকারি কোম্পানির কাজে যোগ দিয়েছি । এই লালগড় "মাওবাদী লালগড়" নামে গোটা বিশ্বে সর্বাধিক পরিচিত ।
প্রথমে আমি কাজে যোগ দিতে ইতস্তত করছিলাম, কিন্তু এম.এ ,বি.এড পাস করে আর কতদিন বসে বসে বাপের হোটেলে খাবো! নিজেরও তো একটা আত্মসম্মান বলে জিনিস আছে। তাছাড়া বাবা-মা মুখ ফুটে কোনও দিন  কিছু না বললেও তারাও  চায় যে আমি কিছু একটা কাজ করি। অন্তত নিজের সামান্য  হাত খরচটা চালানোর মতো উপার্জন করলেও বাপের কাছে আর হাত পাততে হবে না,..... এই ভেবে বেসরকারি কোম্পানির কাজে যোগ দিই।

সবাই জানে কোম্পানির কাজে একটু চাপ বেশি থাকে।তবুও রবিবার দিনে কর্মব্যস্ততার শৃঙ্খল ছিন্ন করে  মুক্ত বিহঙ্গের মত পাখনা মেলে সারা লালগড় মুক্ত সিংহের মতো চোষে বেড়ায় ।লালগড়ের বুকের উপরে যে নদীটি নুড়ি পাথরের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে দিতে কুলকুল শব্দে গান গাইতে গাইতে বয়ে চলেছে তার নাম...কংসাবতী।
এই নদীর সদ্য পাথর বিছানো পাড়ে বসে আমি কাটিয়েছি কত সোনালী বিকেল। নির্জনে বসে প্রকৃতির সাথে খেলা করার যে কি আনন্দ! যারা খেলার সঙ্গী, তারায় একমাত্র জানে। সেদিনও সূর্যাস্তের দিকে মুখ করে,প্রকৃতির সাথে খেলতে খেলতে, কানে হেডফোন লাগিয়ে মোহাম্মদ আজিজ এর গান শুনছি।
নদীর পাড় ধরে পিচঢালা যে সরু রাস্তাটি জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে। সেই রাস্তায়
খুব একটা গাড়ি-ঘোড়া চলে না। হঠাৎ"দড়াম" করে একটা আওয়াজ। হেডফোনের গানের সুরকে চাপিয়ে এই আওয়াজ আমার কানে এসে সজোরে ধাক্কা মারল। রাস্তার দিকে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, পাশেই একটি মেয়ে লাল রঙের স্কুটি চাপা নিয়ে পড়ে আছে।নিজের থেকে উঠবার ক্ষমতা টুকু নেই। গাড়ি চাপা নিয়ে ছটপট করছে। হয়তো নতুন ড্রাইভার!নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে গিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি দৌড়ে গিয়ে মেয়েটিকে দুই হাত ধরে টেনে তুলি। থর থর করে সে  কাঁপছে । সম্ভবত খুব ভয় পেয়েছে।
আমি লাল রঙের স্কুটি টি তুলতে তুলতে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, ভয় পাওয়ার কিছু নেই ।যা হবার হয়ে গেছে । ভাগ্য ভালো যে, তোমার কিছু হয়নি। খুব জোর বেঁচে গেলে । সে মুখ দিয়ে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।জানিনা সে কি ভাবছে!
"....কি নাম ?"বিহ্বল ভাব কাটিয়ে আমি জিজ্ঞাসা করি।
আমার প্রশ্নের উত্তরে সে  জানালো প্রিয়া, ভালো নাম বিষ্ণুপ্রিয়া।
".... তুমি কি করো?" উৎসাহভরে জানতে চাইলাম।
সে একটু স্মিত হেসে আমাকে আড়চোখে দেখে বলে,"লালগড় গভমেন্ট কলেজে ।ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।"

পশ্চিমের সোনালী সূর্যটা ঘন শাল গাছের দিগন্তের পারে অস্ত চলে গেছে। এই সময় এমন নির্জন জায়গায় কোন মেয়ের সাথে কথা বলা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়!অন্য কোনো শহরের জায়গা হলে তাও সম্ভব।লালগড়ের মত মাওবাদী প্রভাবিত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে একা কোন অপরিচিত মেয়ের সাথে কথা বলা !কল্পনা করা যায়??
....এ কথা মনে হতেই আমার গা কাঁটা দিয়ে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত খাঁড়া ওঠে। প্রিয়াকে বললাম, গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যেতে পারবে তো?
সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
আমি  স্কুটিটি স্টার্ট করে তাকে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, সাবধানে যেও কেমন!
গাড়িতে চেপে একগুচ্ছ ধুলোবালি উড়িয়ে,আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে লাল স্কুটিটি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।
হেডফোনে গান শুনতে শুনতে আমি নিজের ভাড়া বাড়িতে চলে এলাম। নরম বিছানা পেয়ে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিলাম।
              *************(2)*************
আমি তখন কলেজে পড়ি। আমার গ্রামের পাশেই কলেজ ।তাই আমি সাইকেলে করেই প্রতিদিন কলেজে যেতাম।
এই যাওয়া-আসার পথে ময়না বলে একটি মেয়ের সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে আমার খুব  ভালো বন্ধবী ছিল ।আমি তাকে কেবলমাত্র বান্ধবী ই ভাবতাম।এর বেশি কিছু কোনোদিন ভাবি নি।
ভালোবাসার অনুভূতি যে কেমন ! তা আমি সেই সময় জানতাম না ।জীবনে কোন মেয়ের প্রেমেও পড়ি নি।আমি এক সাধারন কৃষকের ছেলে ।প্রেম, ভালোবাসা অনেকটা বড় ঘরের ছেলে মেয়েদেরই মানায় ।আমার মত গরীব ছেলের প্রেম করা নৈব নৈব চ। কলেজ লাইফে এটাই ছিল আমার দৃঢ় বিশ্বাস । বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানো শোভা পায় না ।তবুও "ময়না" বলে সেই মেয়েটি কিন্তু আমাকে মনে মনে ভালোবাসত। যদিও এ ভালোবাসা একতরফা ছিল। তার সমস্ত ভালোবাসা  এক সময় আমাকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি অবহেলায় তা প্রত্যাখ্যান করেছি।

টেবিলে রাখা মোবাইলটির রিংটোন বেজে উঠলো।এই সময় আবার কে ফোন করেছে ?উঁকি দিয়ে একটু ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি লেখা উঠছে মিস্টার বস!
মনে আমার অফিসের বস ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই জানতে পারি, আজ লালগড়ের পাশে এক আদিবাসী গ্রামে সার্ভে করতে যেতে হবে।তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যে গাড়িতে করে আমরা গ্রামে গ্রামে সার্ভে করি ,সেই সার্ভে গাড়িতে উঠে বসলাম।
এই কদিনেই আমি লালগড়টাকে আপন করে নিয়েছি। ভালোবেসে ফেলেছি। এখানকার মানুষজন প্রকৃতির মতই নিষ্পাপ, সহজ সরল ।সহজেই এই মানুষগুলি অপরিচিত অতিথি কে আপন করে নিতে পারে।এখানে না এলে আমি জীবনে কোনদিন বুঝতেই পারতাম না, এখানকার মানুষজন এত অতিথি পরায়ন হতে পারে! 
দুদিকে শাল জঙ্গলের বুক চিরে একটি সরু কাঁচা মরোমের রাস্তাটি গ্রামের দিকে চলে গেছে। সেই রাস্তা দিয়েই আমাদের সাদা গাড়িটি জঙ্গলে পড়ে থাকা শালগাছের শুকনো পাতাগুলিকে সাথে উড়িয়ে উড়িয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। গাড়ির জানলা দিয়ে আমি প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে করতে এগিয়ে চলেছি।গোটা জঙ্গলে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে।পাখির কিচিরমিচির ডাক পরিবেশ কে আরোহৃদয়গ্রাহী মনোরম করে তুলছে।কাঁচা রাস্তাটি পেরিয়ে ঢালাই রাস্তার দুইধারে দু একটি কাঁচা মাটির বাড়ি পেরিয়ে আমাদের গাড়ি এসে থামল। গাড়ি থেকে আমি নামতেই ,একটি মেয়ে " ও বাবু" বলে ডাক দিল।
আমি তাকিয়ে দেখি,একটি মেয়ে কাঁখে মাটির কলসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের পলক ফেলতেই দেখি, জলপূর্ণ মাটির কলসিটা থেকে উপচে পড়া জলে মেয়েটির নীলচে রঙের চুড়িদারটির  কিছুটা অংশ ভিজে গেল।
আমি কিছু বলার আগেই, "আমাকে চিনতে পারলেন বাবু?" মেয়েটি লাজুক ভাবে বলল।
মেয়েটির উচ্চতা পাঁচ ফুটের কাছাকাছি।
দেখতে মাঝারি গড়নের। মাথায় শাল ফুলের যেন খোঁপা বাঁধা আছে। তখনও আমি মেয়েটিকে  ঠিক চিনতে পারি নি।যেই সময় তার পরিচয় জিজ্ঞেস করতে যাব,এমনি সে বলে উঠল,
"আমি বিষ্ণুপ্রিয়া।
কলেজে পড়ি ।লালগড় কলেজে।
আমাকে চিনতে পারছেন না!
আপনিই তো সেদিন আমাকে বাইক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচিয়েছেন।'
...... ও বুঝেছি। বুঝেছি ।একটু হেসে আমিও বললাম।
....."আসুন আমাদের বাড়ি।" গোলাপি রঙের লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটে একটু  মিষ্টি হেসে বলে । সেই হাসি কি সুন্দর! হাসিতে যেন মুক্তো ঝরে পড়েছে।
"..... কোনখানে তোমার বাড়ি ?" শান্ত ভাবেই আমি জানতে চাইলাম।
বিষ্ণুপ্রিয়া নারকেল গাছের মাথার ওপারে একটি মাটির বাড়ির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিল। তখনও ঠোঁটের কোণে লেগে আছে সেই মিষ্টি হাসি।
               *************(3)***************
সার্ভে থেকে ফিরে এসে নিজের বেডরুমে সোফায় হেলান দিয়ে হেডফোনে আমার সেই প্রিয় গায়ক মোহাম্মদ আজিজ এর গান শুনছি। কিন্তু আজ আর গান ভালো লাগছে না ।কেন জানিনা ,দেয়ালে দেয়ালে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়ার ঠোঁটের কোণে সেই মিষ্টি হাসিটাই মনে পড়ছে। তার হাসিটা আমাকে যেন পাগল করে তুলেছে। কলেজে যখন পড়তাম তখন ভালোবাসা যে কি জিনিস বুঝিনি। কিন্তু আজ কেন আমার হৃদয় জুড়ে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়া!

এখন প্রতি রবিবার আমি সময় করে বিষ্ণুপ্রিয়ার সাথে কংসাবতী নদীপাড়ে দেখা করি। এখানেই তো তার সাথে আমার প্রথম দেখা।আমার ভালো লাগা।ধীরে ধীরে আমাদের মধ্যে একটা প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে।আমাদের দুজনের মধ্যে ধ্যান-ধারণার, মনের, এক অদ্ভুত রকমের মিল ছিল। ইদানিং দুজন দুজনকে ছাড়া এ জগত অন্ধকার দেখতে পাই।কোন কোন দিন পাখিরা যখন একে একে নিজের বাসায় ফিরতে শুরু করেছে, তখনও আমরা দুজনে পাশাপাশি কংসাবতীর নদীর পাড়ে বসে বসে একটি, দুটি,তিনটি করে পাখি গুনে চলেছি।সব পাখি যখন গোনা শেষ হতো তখন আমরাও বাড়ি ফিরতাম।


আগুনের সামনে ঘি থাকলে যেমন একটু একটু করে হলেও ঘি গলতে শুরু করে।সম্পর্ক যখন খুব গভীর হয় তখন রক্তমাংসের শরীর কখনো কখনো কাছাকাছি চলে আসে। তখন শরীরও  কথা বলতে শুরু করে।
বিষ্ণুপ্রিয়া আমাকে হঠাৎ তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,  "যদি কোনদিন আমি তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাই । তুমি কি করবে?"
আমি এক হাতে তার মুখ চাপা দিয়ে বলি, এমন কথা আর কখনো মুখে আনবে না। তোমাকে ছাড়া আমি যে বাঁচতে পারব। তুমি আমার জান, তুমি আমার জ্ঞান, তুমি আমার ধ্যান।
.....".চল না , আমরা দুজনে পালিয়ে বিয়ে করি।"
আমার ঠোঁটে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে সে বলে।
বিষ্ণুপ্রিয়ার মাথার শেম্পু করা চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে আমি বললাম ...
না,না,আমি পালিয়ে গিয়ে কখনই বিয়ে করতে পারবো না। বাবা-মাকে বুঝিয়ে অনুষ্ঠান করে, আর  পাঁচজন  মানুষ যে ভাবে বিয়ে করে,আমিও সেভাবেই তোমাকে বিয়ে করব। তুমি কিছু চিন্তা করো না।  স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব।
              ****************(4)******************
রাত দশটার সময় কোম্পানি থেকে এমার্জেন্সি ডাক এলো ।পরের দিনেই আমাকে দার্জিলিং যেতে হবে।কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া কে খবর টা আমার আর দেওয়া হলো না।"যে আমি দুমাস পরে ফিরে এসে আমাদের বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে সব কথা জনাব।" যাকে  দুদণ্ড না দেখলে মনটা আনচান করে ,তাকে দুমাস দেখতে পাবো না ।কোনো কথা বলতে পাব না। এটা ভেবেই মনটা বিষাদে ভরে উঠল। কিন্তু কি আর করা যায় কোম্পানি চাকরি! যেতে তো হবেই ।অগত্যা দার্জিলিং পাড়ি দিলাম।
দার্জিলিং জায়গাটাও আমার বেশ ভালই লাগলো। এখানে চা বাগানের দৃশ্য, পাহাড়ের কোলে টাইগার হিলের সূর্যোদয়.....।তবুও দিনের শেষে ,দার্জিলিং এ থাকলেও আমার মন পড়ে থাকতো সেই লালগড়ে ই।দার্জিলিংএ রাত্রে ঠিক মতো আমার ঘুমও হয় না।বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু বিষ্ণুপ্রিয়ার কথায় মনে পড়ে।
জানিনা এখন বিষ্ণুপ্রিয়া কেমন আছে? কি করছে?
কিন্তু আমার মন বলছে সে ভালো নেই ।প্রতিটা মুহূর্ত তাকে দেখার জন্য আমার মন ছটফট করছে। আর দেরি নয়, আমি বাড়ি ফিরেই বিষ্ণু প্রিয়ার সাথে আমার বিয়ের পাকা কথা সেরে নেবো। আমার কথা বাড়ির বাবা-মা কেউ অমান্য করতে পারব না ।এটুকু আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে।
দেখতে দেখতে দার্জিলিংএ আমার নিরানন্দ ভাবে বহু কষ্টে দুটো মাস কেটে গেল। আগামীকালই  আমি লালগড় ফিরে যাব। সেখানে গিয়ে প্রথমে বিষ্ণুপ্রিয়া কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব। আশা করি সে আমাকে ক্ষমা করে দেবে। হঠাৎ ই তাকে না জানিয়ে দার্জিলিং চলে এসেছি।

রাতের ট্রেনেই আমি হাওড়া চলে আসি।তারপর লালগড়।.......
লালগড়ে নেমেই প্রথমে আমি আমার হবু জীবনসঙ্গিনী বিষ্ণুপ্রিয়ার খবর নিই। বিষ্ণুপ্রিয়ার একমাত্র ছোট ভাই কাঁদিতে কাঁদিতে জানালো, তার দিদি আর বেঁচে নেই। 

গত মাসেই সর্প দংশনে বিষ্ণুপ্রিয়া এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে ,সমস্ত পার্থিব বন্ধন ছিন্ন করে, না ফেরার দেশে চলে গেছে।........



ইন্টারভিউ

ঘড়িতে এলার্ম দেওয়া আছে।ভোর ৪টা ১০এ।কিন্তু ঘুম কিছুতেই হচ্ছে না। দুই চোখ যেন রক্ষীবাহিনীর মতো জেগে আছে। আর আছে একটু টেনশন টেনশন ভাব।রাত ৮টাই শুনছি একটি বাম রাজনৈতিক পার্টি আবার বাংলা বনধ ডেকেছে। গাড়ি ঘোড়া কিছুই চলবে না।আমার ভাগ্যের কি পরিহাস! আমার ইন্টারভিউ যে দিন, সে দিনেই ধর্মঘট!  ভাবতেই গা কাঁটা দেয়। কি যে হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।প্রচন্ড টেনশনে আছি।সঠিক সময়ে আমি স্কুলে পৌঁছাতে পারব তো?

না,না,আকাশ পাতাল ভেবে আজ আর কাজ নেই।আমাকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়তে হবে।আগামীকালই ইন্টারভিউ। একটা ভিজে রুমাল দুই চোখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে রইলাম। কিন্তু কথায় বলে না.."খাও বললে বনের বাঘেও খাই না!" ঘুম আর কিছুতেই আসে না।গন্ডা দুয়েক পরীক্ষা দেওয়ার পর কত সাধনায় এই প্রথম কোন ইন্টারভিউতে ডাক এলো।আর যদি না যেতে পারি......
না,না আমাকে যেন তেন প্রকারে সেখানে পৌঁছাতেই হবে।দেওয়াল ঘড়িতে তখন রাত ১২টা ১০ পেরিয়ে গেছে। এতো রাত্রে আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধুকে ফোন করি। সে জানাল যে,ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।আর ছোট খাটো দুই চার চাকার দুই একটা গাড়ি চলবেই।.....একথা শুনে মনে মনে কিছুটা ভরসা পেলাম।

পরীক্ষার সেন্টার পড়েছে পুরুলিয়া জেলার চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে।এই স্কুলটা আমার পূর্ব পরিচিত। গত বছর পি,এস,সি পরীক্ষার সিট সেখানেই পড়েছিল। পুরুলিয়া ষ্টেশন থেকে প্রায় তিন কিলোমিটারের মতো হবে।সে যায় হোক, আমার তন্দ্রাভাব আসতে না আসতেই ঘড়ির এলার্ম টা বেজে উঠলো।  আমি তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে পড়লাম। চারিদিক তখনো ঘোর অন্ধকার।আমাদের বাড়ির লাল মোরগটা আমাকে দেখে সপ্তম সুরে ডাকিতে লাগলো।আমি ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে গড়বেতা-রাঁচি প্যাসেঞ্জার ধরে ইন্টারভিউর উদ্দশ্যে রওনা দিলাম।

পুরুলিয়া ষ্টেশন এ নেমে দেখি,গুটিকতক টোটো আর রিক্সাওয়ালা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
একটি টোটোওয়ালাকে বললাম....
দাদা,চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে যাবেন?
------ হ্যাঁ যাবো।গাড়িতে বসুন!
------- কত ভাড়া দাদা?
-------পঞ্চাশ টাকা লাগবে।
-------এইতো গত বছরেই মাত্র পনেরো টাকা ভাড়াতেই ওই স্কুলে গেছি।আর আপনি চাইছেন পঞ্চাশ টাকা! একেই বলে কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ!

পাশের রিক্সাওয়ালা দাদাটি সব শুনতেছিল।আমি যখন বললাম,পনেরো টাকা হলে যাব।না হলে যাব না।তখন পাশের রিক্সাওয়ালা দাদাটি কাছে এসে আমাকে বলল....
"আসুন বাবু, আমি পনেরো টাকাতেই নিয়ে যাব।"
আমি তার পুরনো ভাঙ্গা রিক্সাতেই ওঠে বসলাম।
দাদাটির বয়েস আনুমানিক ৩০-৩২ বছর হবে।রিক্সাটি ষ্টেশনকে পিছনে ফেলে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে এগিয়ে যেতে লাগল।আমি দাদাটিকে জিগ্যেস করলাম....
দাদা,আপনি পনেরো টাকাতেই রাজি হলেন কেন?
সে কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘামটা মুছে বলল, জানেন বাবু,এখন যে হারে টোটোর সংখ্যা বাড়ছে সে হারে বডি রিক্সাওয়ালা গুলো মারা যাচ্ছে।এখন নাকি ডিজিট্যাল যুগ।আধুনিক যুগ।
এখন মানুষ আর বডি রিক্সাতে চাপতে চাইছে না।আর বডি রিক্সায় না চাপলে, আমাদের সংসার চলবে কি করে বলুন! বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমি সংসারটাকে বাঁচাতে রিক্সা চালাতে শিখি।গত দুই দিন থেকে আমার বাড়ির লোকজন না খেয়ে উপোষ করে আছে বাবু।বাড়িতে একদানাও অন্ন নেই।পনেরো টাকা কেন বাবু,আমি দশ টাকাতেও রাজি হতাম।

রিক্সাওয়ালার দু:খের জীবনযাপনের কথা শুনে আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল।আমার দুটি চোখ অজান্তে কখন অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছে বুঝতেই পর না।পদ্ম পাতায় জল ফেললে যেমন হয়,তেমনি আমার চোখের অবস্থা।রিক্সাতে আজ  না চাপলে বুঝতেই পারতাম না মানুষ কত কষ্টে দিন কাটায়? ক্যাচ ক্যাচ শব্দে রিক্সা ছুটে চলেছে আর রাস্তার দুই ধারে বড় বড় বিল্ডিং গুলো আমদেরকে স্বাগতম জানিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে রিক্সার তালে তালে দাদাটির  সংসারটিও এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ দাদাটি আমাকে জিগ্যেস করেন...
বাবু,আপনার বুঝি আজ ইন্টারভিউতে ডাক আছে?
-----হ্যাঁ দাদা,ডাক আছে।
-----ভাল ভাবে ইন্টারভিউ দিও।পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করো।
আমার কি যেন মনে হল,জিগ্যেস করে ফেললাম,
----দাদা,আপনি লেখাপড়া করো নি?
-----করেছি বাবু।বাংলায় এম,এ পাশ করেছি।দাদা, জানেন আগামীকাল আমারও ওই স্কুলেই ইন্টারভিউর ডাক আছে।
....একথা শুনে আমি তো থ হয়ে গেলাম।মনে মনে ভাবলাম ভাগ্যের কি পরিহাস! সারাটা দিন রিক্সায় হাড় ভাঙা খাটুনি। এম,এ পর্যন্ত লেখাপড়া।তারপর আবার আগামী কালই  ইন্টারভিউ আছে।
গল্পের তালে তালে কখন যে চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলে পৌঁছে গেছি বুঝতেই পারি নাই। রিক্সা থেকে নেমে পড়লাম।দাদাটিকে পঞ্চাশ টাকায় ভাড়া দিতে চাইলাম।কিন্তু সে পনেরো টাকার এক টাকাও বেশি নিল না।ভিড়ের মাঝে হেঁটে চলেছি চিত্তরঞ্জন গার্লস হাই স্কুলের পথে।একটা প্রশ্নই মাথায় নদীর স্রোতের মতো ঘুরপাক খেতে লাগল। আমার ইন্টারভিউ আছে, রিক্সাওয়ালা দাদাটিরও ইন্টারভিউ আছে........



আইসক্রিম

"দাদা ও দাদা ,দুটো টাকা দাও না!
দাদা ,দুটো টাকা দাও না! আইসক্রিম খাব।"
মেয়েটির কাতর অনুরোধ নদীর ঢেউর মতো আছড়ে পড়ছে,চলন্ত পুরুলিটা এক্সপ্রেস ট্রেনের গোটা কামড়াটাই।
আমার পাশের সিটে বসে খবরের কাগজ পড়তে থাকা ভদ্রলোকটি চশমার ফাঁক দিয়ে একবার  দেখে নিল সেই মেয়েটির আপাদমস্তক। বয়স আট কি নয় হবে।
জীর্ন দেহ,যেন বহু যুগ ধরে ক্ষুধার্ত, মাথার এলোকেশী রুক্ষ চুলগুলো সামান্য একটু তেলের অভাবে কেমন যেন জটা জটা, হাতে একটা ফুটো থালা।তাতে দু চার টাকা খুচরো।
আবার মেয়েটির সকরুণ আবেদন...
"দাদা,ও দাদা, দুটো টাকা দাও না!
দাদা,দুটো টাকা আমায় দাও না! আইসক্রিম খাব.....
মেয়েটির কাতর অনুনয়টি যেন ঐ ভদ্রলোকটির  কর্ন মূলে গরম তেলের মতো প্রবেশ করল।
হাতের খবরের কাগজটা তাড়াতাড়ি নামিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে গজগজ করে বলে উঠল .....
"দুটো টাকা দাও...আইসক্রিম খাব.....চল,এখান থেকে চল।.....আইসক্রিম খাব। ।....তোদের বিষও জোটে না!
আমার মনে দোলা দিয়ে যায়,দুটো টাকার জন্য কত মানুষ লাঞ্ছিত হয়! ভদ্রলোক টির  কথার কোন উত্তর না দিয়ে মেয়েটি তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে দুটো টাকা চাইতে চাইতে গেটের কাছে চলে যায়।
সাধারণ মানুষ বহু টাকা কাজে অকাজে ব্যয় করে।কিন্তু যে দুটো টাকা  ভিক্ষে চাই,সেই ভিখারিকে দান করতে মন চাই না। কি বিচিত্র আমাদের এই ভারতবর্ষ! আমাদেরই দানে মন্দিরের প্রনামি বাক্স উপচে পড়ে! কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষ খেতেও পায় না।
কোন দিক থেকে কালবৈশাখী ঝড়ের বেগে দুটো যমদূত, থুড়ি আর পি এফ পুলিশ এসে মেয়েটির কাছে হাজির ।এ কি কান্ড! ছোট্ট মেয়েটাকে ধরে গলাধাক্কা দিতে দিতে এক পুলিশ ধমকের সুরে বলে,কতবার বলেছি না,....এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠবি না।কথা কানেই ঢুকে না। .....এরপর যদি ট্রেনে দেখি.....মেরে তোর দুটা .....ঠ্যাং ভেঙে দিব। 
ধাক্কা সামলে ছোট্ট মেয়েটি করুন দৃষ্টিতে বলে,বাবু,আমরা খাব কি? ভিক্ষে না করলে আমাদের কেউ খেতে দেয় না বাবু।
কিন্তু কেই বা শুনে একজন ভিখারির কাতর অনুরোধ!
এক পুলিশকর্মী মেয়েটির চুলেই মুঠি ধরে
দু চার বার থাপ্পড় দিতেই মেয়েটির হাতের থালাটা পড়ে যায়।খুচরো পয়সা গুলি ট্রেনের সিটের নিচে  নিশ্চিন্তে আশ্রয় নেয়।
ট্রেনটা স্টেশনে একটু থামতেই মেয়েটিকে টেনে হিঁচড়ে তারা প্লাটফর্মে নামিয়ে দেয়।জানালার ফাঁকে দেখি,মেয়েটির দু চোখ থেকেই অবিরাম ভাবে জল গড়িয়ে পড়ছে.....।সেই জল থেকেই কি আইসক্রিম তৈরি হয়??


জীবন- তরী

ভালোবাসার মানুষটির সাথে চার হাত এক হওয়ার যে কি অনাবিল আনন্দ! সারা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বোধ হয় পাওয়া সম্ভব নয়।হাজার ঝড় ঝঞ্ঝা অতিক্রম করে জীবন তরীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া ,শুধু মুখের কথা নয়। খুবই জটিল কাজও বটে। আর সেই জটিল কাজও সম্ভব হয়ে ওঠে, যদি তাদের ভালোবাসা খাঁটি সোনার মতো হয়। সেই ভালোবাসার উপর বিশ্বাস করে অবিকল আর অঞ্জনার মতো সুখী আজ আর কেউ নয়। কোর্ট থেকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে অঞ্জনা তার বরের হাতটি ধরে পায়ে পা মিলিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে অবিকলের শরীর ঘেঁষে কনুইটে আলতো করে ঠেকিয়ে,নাড়া দিয়ে বলে,
" তুমি এত সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে পারো, আমি ভাবতেই পারি না!'
অবিকল প্রথমে অঞ্জনার মুখের দিকে,তারপর মাথার সদ্য লাল টুকটুকে সিঁদুরের দিকে আড় চোখে একটু তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, 
"এছাড়া আমার কাছে কোনো উপায় ছিল না অঞ্জনা।"

কিছুটা পথ হাত ধরে হাঁটার পর, কোর্টের মেন গেটের কাছে একটি লম্বা চেয়ার ছিল, যেমনটি রেল স্টেশনে দেখা যায়, সেই চেয়ারে গিয়ে তারা দুজন বসে পড়ে।কত হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে আজ এখানে তারা পৌঁছেছে! সে পথ মোটেই মসৃন ছিল না।সে কথা মনে হতেই অবিকলের সারা গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। কণ্টকাকীর্ণ সে পথ। তবুও তারা সে সব বাধা অতিক্রম করে কিভাবে বিজয়ী হল,সে কথায় ফিরে আসি।
অঞ্জনার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে তার মা বলে, "যা একবার তোর ছোট মাসির বাড়ি ঘুরে আয়। তোর মাসি সেদিনও ফোন করে বলেছে, তোর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলে যেন একবার মাসির বাড়ি ঘুরে আসিস।"
অঞ্জনার তার মায়ের প্রস্তাবটি শুনতে খুব মন্দ লাগলো না ।উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর প্রায় মাস দুয়েক ছুটি পাওয়া যায়। তাছাড়া পরীক্ষার সময় রাত জেগে অনবরত পড়ে পড়ে দেহ, মন... দুই-ই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জীবনটাও কেমন যেন একঘেয়েমি হয়ে ওঠে।সবারই শরীর রক্ত মাংসে গড়া।শরীর তো কোনো যন্ত্র নয় ।তারও তো মুক্তি চাই, ছুটি চাই।তাছাড়া অঞ্জনার যখন বয়স পাঁচ কি ছয় বছর হবে, সে সময় অঞ্জনা মাসির বাড়ি গেছে ।আর কোনোদিন যাওয়া হয়নি।মায়ের প্রস্তাব শুনে আনন্দে লাফাতে লাফাতে সে জানাই...
"ঠিক আছে।তবে কালকেই যাব।"
অঞ্জনার ছোট মাসির বাড়ি পুরুলিয়ার ভাট বাঁধ এর কাছে। বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় এই মুহূর্তে তার ঠিক  মনে নেই। তবে তার মাসির নাম অপর্ণা রায়।মাসি পুরুলিয়ার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে চাকরি করে। ...এটুকু তার স্পষ্ট মনে আছে। অঞ্জনা ভাট বাঁধ মোড়ে একটি পান দোকানের কাছে গিয়ে তার মাসির পরিচয় দিয়ে জানতে চাই মাসির বাড়িটা কোন খানে? সে সময় পান দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যুবক  অপরিচিত মেয়েটিকে বিনম্র ভাবে বলে,
"কোন অসুবিধা না থাকলে আমি তোমাকে উনার বাড়ি দেখিয়ে দিতে পারি। আমার বাড়ি ওইখানেই।আমরা একই পাড়ায় থাকি।"


অঞ্জনা প্রথমে অপরিচিত লোকের সাথে যেতে একটু ইতস্তত করে। তারপর দিনের মাঝে ব্যস্ত রাস্তায় কি আর হবে !.....এই ভেবে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বলে, "ঠিক আছে। চলো ।


কলেজ ইনফর্ম পরা ছেলেটি তার নিউ হিরো সাইকেলটি একটি হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলে,...." তুমি এই প্রথম মাসির বাড়ি আসছো নাকি?"
..অঞ্জনা সহজভাবেই বলে , "তা হয়তো ঠিক নয় ।একবার খুব অল্প বয়সে এসেছি। তাই বাড়িটা ঠিক মনে পড়ছে না।"

সেই অপরিচিত ছেলের সাথে পায়ে পা মেলে ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে পিঠের ব্যাগটা সাইকেলের ক্যারিয়ারের নামিয়ে দিয়ে বলে, "তোমার নামটা কি আমি জানতে পারি ?"
...অবশ্যই ।আমার নাম অবিকল। তোমার?
... অঞ্জনা। পুরো নাম অঞ্জনা রায়।
... বাহ কি মিষ্টি নাম!
নামের প্রশংসা শুনে, অঞ্জনার শুধু ওষ্ঠাধর একটু প্রসারিত হয়। তারপর একটু ফিক করে হেসে বলে, "তুমি কি কর?"
...কলেজে পড়ি। তুমি?
....আমার তো এই সবে উচ্চমাধ্যমিক শেষ হল।
..."এই তো !এসে পড়েছি। ওই সবুজ রঙের দেওয়াল, এডবেস্টার লাগানোর নতুন বাড়িটাই তোমার মাসির বাড়ি।" অবিকল থমকে দাঁড়িয়ে ডান হাতের আঙুল নির্দেশ করে বলে।
..." ও আচ্ছা !ধন্যবাদ ।"..বলে অঞ্জনা সাইকেলের কেরিয়ারে রাখা তার ভারী ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে,হেলতে দুলতে চলে গেল ।
অবিকলও "ওয়েলকাম"জানিয়ে পাশের গলি দিয়ে তাদের দোতলা বাড়ির দিকে পা বাড়ালো।
অবিকলের বাবা এক সময় খুব উঁচু পোস্টে রেলওয়েতে সার্ভিস করতো। বর্তমানে রিটায়ার করার পর একটা বড় গোলদারি দোকান দিয়েছে।এখনও ওই পাড়ায় তিনিই সম্ভবত আর্থিক দিক দিয়ে বিচার করলে বড়লোক । গোটা পাড়া তাকে কৃপণতার জন্য এক ডাকে চেনে।


অঞ্জনা গ্রাম্য মেয়ে। গ্রামের গাছপালা প্রকৃতির মতোই সহজ-সরল। তার সাদা মনে কাদা নেই। এই সহজ-সরল স্বভাবের কারণে অবিকলের সাথে অচিরেই  বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।অবিকলও ওই একই স্বভাবের উদার হৃদয়ের মানুষ।
সেদিন টিউশন থেকে ফেরার পথে পাড়ার মোড়ে একটি পান দোকানে অবিকল সাইকেলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠে কে যেন একটা নরম হাত ঠেকাল।সে ভুত দেখার মত চমকে পিছন ঘুরে দেখে, অঞ্জনা পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে একটু একটু করে হাসছে।
.... "ভয় পেলে নাকি ?"অঞ্জনা হাসতে হাসতে বলে।
ভয়টা কেউ যাতে বুঝতে না পারে,তাই অবিকল গলা খাঁকারী দিয়ে বলে,
"না, না ,ভয় পাবো কেন ?"
অঞ্জনা বুঝতে পারে একটু হলেও অবিকল ভয় পেয়েছে।পিঠের থেকে হাতটি সরিয়ে সাইকেলেটি ধরে বলে, "তুমি এখন বাড়ি যাবে তো?"
... "হুম" অবিকল শুধু একটি শব্দ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে, চুপ করে থাকে।
"চলো ।তাহলে আমিও যাই ।"..এই বলে অবিকলের সাইকেলে বসে পড়ে ।
সাইকেল চালাতে চালাতে অবিকল জিজ্ঞাসা করে, "উচ্চ মাধ্যমিকের পর তুমি কি নিয়ে পড়াশোনা করবে ?"
..."মাসি বলেছে "জি এন এম," করতে।কিন্তু আমার তো ইচ্ছে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে পড়বো।" ..অঞ্জনা আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে ওঠে।
....." দুটোই ভালো এরপর তোমার যেটা ইচ্ছা সেটা করো।" কথা গুলো অবিকল আত্মবিশ্বাসের সুরে বলে যায়।
আরো হাজার কথা আদান- প্রদান করতে করতে তারা সেদিন বাড়িতে পৌঁছে।
  
  ★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★

উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে অঞ্জনা নিস্তারিনী ওমেন্স কলেজে জিওগ্রাফি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। মাসি বাড়ি থেকে কলেজ যাতাযাত করার ফলে এখন প্রায়ই অবিকলের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়। অচিরেই তাদের বন্ধুত্ব ভালবাসায় পরিনত। কলেজ থেকে ফেরার সময় পুরুলিয়া সুভাষ পার্ক এ এখন বেশিরভাগ সময় তাদের কাটে। দুজন মিলে সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়া, সাইকেলে চেপে বাড়ি ফেরা,.... গ্রামের অনেকেই চোখে ভালো ঠেকে না। শুধু গ্রাম নয়, শহরেও দুজন ছেলে মেয়ের প্রেম- ভালোবাসা অনেকেই খোলা মনে মেনে নিতে পারে না। যত হোক না কেন, এটা একবিংশ শতাব্দী।গ্রামের প্রতিবেশীরাই তিলকে তাল করে তাদের মেলামেশার সমস্ত ঘটনা মাসিমার কানে দেই। অভিযোগ শুনতে শুনতে যখন মাসির কান ঝালা পালা হয়ে ওঠে, তখন অঞ্জনাকে দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে তার মাসি হাফ ছেড়ে বাঁচে। মাসি ভাবল, যাক আপদ মিটে গেল।এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।কিন্তু না।
এই ঘটনাগুলি ঝড়ের বেগে এক কান থেকে আরেক কানে যেতে যেতে অবিকলের বাড়িতে আছড়ে পড়ে।

অবিকলের বাবা ছেলের কীর্তি শুনে রেগে অগ্নিশর্মা। তার মনের সুপ্ত বাসনা ছিল, যে ছেলের বিয়ে দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় লক্ষ টাকা হাতে পাবে। সেই গুড়ে বলি! সে ভাল করে জানে,ছেলে ভালোবেসে বিয়ে করে বাড়িতে বৌ তুললে একটা কানাকড়িও মিলবে না। তাই সে অবিকলকে ডেকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে, সর্বশেষে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেই, যে "গরিব ঘরের মেয়ে অঞ্জনা"-কে সে এ বাড়ির বউ বলে কখনোই মেনে নেবে না।
অঞ্জনা যে দিন মাসির বাড়ি থেকে একপ্রকার বিতাড়িত হয়ে নিজের বাড়ি গেল।সেদিন থেকেই সে গৃহবন্দি। ঘর থেকে বেরুনোর জো নেই। সাথে সাথে অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।বাড়ির লোকজন বলে দিয়েছে, এক মাসের মধ্যে তার বিয়ে অন্য কোথাও দিয়ে দেবে।
"কলেজে এডমিট কার্ড তুলতে হবে"
...এই বলে, বাড়িতে ফাঁকি দিয়ে দুই সপ্তাহের বন্দী জীবন থেকে অঞ্জনা সাময়িক মুক্তি পেল। কথা মত পুরুলিয়া সুভাষ পার্কে অবিকলের সাথে দেখা করে কাঁদো কাঁদো ভাবে বলে, " তুমি কিছু একটা করো।জোর করে বাড়িতে এই মাসেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। শুনেছি আগামী কালকেই লোকজন ছেলের বাড়ি আশীর্বাদ করতে যাবে।"

অবিকল, আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, " কি যে করতে হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। বাবা- মা তোমাকে কিছুতেই মেনে নেবে না। তোমার ব্যাপারে বাবা একথায় না বলে দিয়েছে ।"
..."তবে কি হবে আমাদের!" অঞ্জনা উদাস ভাবে বলে।
অঞ্জনাকে বুকে টেনে, দুহাত দিয়ে চেপে ধরে, বলে," তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমি সব হারাতে রাজি আছি।আমি যাকে ভালোবাসি, তাকে জীবন দিয়ে হলেও আজ রক্ষা করব।"
অঞ্জনা, অবিকলের কোলে মাথা রেখে,চোখে চোখ রেখে,বলে ওঠে, "আমি আর বাড়ি ফিরে যাব না। বাড়িতে মার খেয়ে মরার চেয়ে তোমার কোলে মাথা রেখে মরায় শ্রেয়। "
.. অবিকল ,অঞ্জনার মাথার ঘন কালো চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলে, " আমি বেঁচে থাকতে এমন কথা বলো না। আমি কিছু একটা বাঁচার উপায় বের করবই। "

অঞ্জনার এক বান্ধবী বছর খানেক আগে ভালোবেসর  কোর্টে গিয়ে রেজিস্ট্রি মেরেজ  করেছে। এখন বেশ সুখেই স্বামীকে নিয়ে ঘর করছে। অবিকলের সে কথা জানা ছিল,তাই অবিকল অঞ্জনার হাত ধরে,হাসি মুখে বলে,
বাড়িতে যখন কেউ আমাদের ভালোবাসার মূল্য দেবে না ।আমাদের বিয়ে দেবে না।" তখন চলো। আমরা তোমার বান্ধবীর মতো কোর্টেই গিয়ে বিয়েটা করি।"
আনন্দে অঞ্জনা অবিকলকে বুকে জড়িয়ে ধরে জীবন সমুদ্র পড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখে।....


.........সমাপ্তি..........


সেই চিঠিটা

পোস্ট মাস্টারের ডাকে কাঁচা ঘুমটা ভেঙ্গে গেল বিশ্বজিৎ এর। পোস্ট মাস্টারের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে এক ঝলক উপরের নামটা দেখেই তার সারা শরীরে যেন একটা বিদ্যুত চমকে গেল। 
বুকের ভিতর একটা মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হতে লাগলো। যে ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল আজ থেকে দশ বছর আগেই।
পোস্টমাস্টারের হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে, না খুলে দেখেই নিজের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রেখে দেই। তার স্মৃতিপটে চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই অতি পরিচিত একটা মেয়ের মুখ। যদিও সেসব আজ থেকে এক দশক আগেকার ঘটনা।

বিশ্বজিৎ গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল। এতদিন পরে অনামিকা কেন আমাকে চিঠি লিখল?
তাহলে কি তার কোনো বিপদ হয়েছে। 
না, না, তা কখনো হতে পারে না । বিশ্বজিতের মুখ দিয়ে অজান্তেই এই কথাগুলো বেরিয়ে যায়। 
তখনও সন্ধ্যা হয়নি।সোনালী সূর্যটা নীল আকাশের পশ্চিম দিকের কোণে তখনও অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে ।পাখিরা একে একে নিজের বাসায় ফিরতে শুরু করেছে। ঘরে ফেরার আনন্দে পাখিরা মনের আনন্দে কিচিরমিচির গান ধরেছে। স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলির ছবি।

বিশ্বজিৎ তখন রঘুনাথপুর কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।তাঁর বাবা-মার ইচ্ছা অনুযায়ী সে বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছে ।
এক বৃষ্টিমুখর দিনে কলেজ যাবার সময় অনামিকার সাথে তার প্রথম পরিচয় । অনামিকা তখন রঘুনাথপুর গার্লস স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীতে পাঠরতা। যাওয়া-আসার মাঝেই তাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। যতদিন যায় তাদের সম্পর্ক আরও নিবিড় ও মজবুত হয় । বিশ্বজিৎ নিজের অজান্তেই কখন যে অনামিকাকে ভালোবেসে ফেলে,সে নিজেই বুঝতে পারেনা।আবার নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতোই অনামিকাও বিশ্বজিৎ কে নিয়ে ঘর বাধার স্বপ্ন দেখে।

বিশ্বজিৎ একদিন কলেজ যাওয়ার নাম করে অনামিকাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে চলে যায়। পাশাপাশি দুজনে বসে সিনেমা দেখে ।হঠাৎ-ই অনামিকা তাকে জড়িয়ে ধরে বলে, "তুমি আমাকে আজ কথা দাও। কোনদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো ! যত দুঃখ কষ্ট, বাধা বিপত্তি আসুক না কেন, আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবে তো? জানো আমার খুব ভয় হয়। যদি..." 
ধুর পাগলী ! বিশ্বজিৎ একটু হেসে অনামিকাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
"তোমাকে আমি কি কখনো ছেড়ে যেতে পারি।জীবনে যত ঝড় আসুক না কেন, আমি তোমাকে বুকে জড়িয়ে রাখবো। আজ আমি কথা দিচ্ছি, তোমাকে ছাড়া জীবনে আর কাউকে বিয়েই করব না।"

নদীর স্রোতের তালে তালে তাদের জীবন আরও সামনের দিকে এগিয়ে চলে। 
সেদিন ছিল রবিবার। আকাশে ঘন কালো মেঘ। দূরে মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে । হঠাৎ অনামিকা বিশ্বজিতের বাড়িতে হাজির। সে সময় বাড়িতে আর কেউ ছিল না ।এমনকি সেদিন বাবা- মাও বাড়িতে ছিল না।

অনামিকার এই অসময়ে আগমনে সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে যায়। অনামিকা বাচ্চা মেয়ের মতো শুধুই ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। মুখ দিয়ে কোন কথাই সে বলতে পারছে না । বিশ্বজিৎ পাশে গিয়ে তার চোখের জল মুছে দিয়ে কিছুটা স্বান্তনা দিলে, অনামিকা কম্পিত ঠোঁটে বললো...
"আজ আমায় ছেলে পক্ষ দেখতে এসেছিল । বাবা- মা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে চাই। তুমি এক্ষুনি কিছু একটা ব্যবস্থা করো। না হলে আমাদের ঘর বাঁধার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে।"
---এ কথা শুনে বিশ্বজিতের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়ে গেল ।সে চারদিকে ঘন অন্ধকার দেখতে লাগলো। এখন সে কি করবে? কোথায় যাবে? কিছুই ভেবে উঠতে পারছে না। সামনের মাসেই তার কলেজ ফাইনাল পরীক্ষা । কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিশ্বজিতের জীবনের সমস্ত হিসেব -নিকেশ ওলটপালট হয়ে যায়। ইতিমধ্যেই এক শুভ দিন দেখে অনামিকার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর তার মন না চাইলেও সে শ্বশুর বাড়ি যেতে বাধ্য হয়। বিশ্বজিতের অশ্রুতে সেদিন ধরণী সিক্ত হয়ে উঠেছিল। সে চিৎকার করে সেদিন বারবার ভগবান ডেকেছে।
"ওগো ভগবান! তুমি কি আছ?" 
ভগবান কিন্তু সেদিন বিশ্বজিতের কাতর ডাকে কোন সাড়া দেননি।কোনো উপায় না দেখে বিশ্বজিৎ সেদিনই সিদ্ধান্ত নেয়, জীবনে সে আর কাউকে বিয়ে করবে না। অনামিকার স্মৃতিটুকু বুকে নিয়েই বাকি দিনগুলি বেঁচে থাকবে।
রাতের অন্ধকারে তারারা যখন মিটমিট করছে। বাড়ির সকলেই যখন গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ।তখন অনামিকার সেই চিঠিটা ড্রয়ার থেকে বের করে আস্তে আস্তে নীল রঙের খামটি খুলে সে দেখে,
"বিশ্বজিৎ আমি আজও তোমাকে ভুলতে পারিনি ।গত বছর আমার স্বামী বিষাক্ত মদ খেয়ে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যায়। তারপর থেকেই আমি বড় একা হয়ে গেছি। এভাবে আমি আর বাঁচতে চাই না ।তুমি ভালো থেকো.........।"
ইতি
তোমার অনামিকা 
স্টেশন রোড, নিউ জলপাইগুড়ি

...চিঠিটা পড়ে বিশ্বজিতের মনের মধ্যে যে ভালোবাসার ঝড় উঠে , সেই ঝড় তাকে আর স্থির থাকতে দেয়না। বহুদিনের সুপ্ত ভালবাসা আবার জীবন্ত আগ্নেয়গিরির মত জেগে ওঠে।
তাই বেশি দেরি না করে বিশ্বজিৎ সকালে আদ্রা স্টেশনে "গৌয়াহাটি এক্সপ্রেস" ওঠে পড়ে । অনামিকার ভালোবাসার টানেই সে নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। স্টেশনে নেমে চিঠিতে দেওয়া ঠিকানায় বিশ্বজিৎ রওনা হয়।সেখানে পৌঁছে দেখে ঐ ঠিকানায় কেউ নেই। বাড়ির দরজা মনে হয় ভেতর থেকে বন্ধ ।বিশ্বজিৎ দীর্ঘক্ষণ ডাকা ডাকির পরও কেউ সাড়া দেয়নি। রাগে দুঃখে বিশ্বজিতের চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে ।কোন উপায়ন্তর না দেখে স্থানীয় কিছু মানুষের সম্মিলিত চেষ্টায় দরজায় ধাক্কা দিয়ে দরজাটি ভেঙ্গে ফেলে। ঘরের ভিতরে ঢুকে দেখে, মেঝেতে পড়ে আছে এক টুকরো সাদা কাগজ, তাতে রক্ত দিয়ে লেখা...
"তুমি বিশ্বাস করো বিশ্বজিৎ। আমি এভাবে কখনোই মরতে চাই নি ।আমি তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আর বাঁচতে পারলাম না ।পারলে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও।" 

বিশ্বজিৎ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কোন রকমে দেওয়ালে হেলান দিয়ে, মাথায় হাত নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে।


...................সমাপ্তি................

মঙ্গলবার, ২৮ জুলাই, ২০২০

লালগড়ের আন্দোলন



গভীর অরণ্যে যখন কোনো কারনে আগুন লাগে,অগ্নির লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে, আর সেই অগ্নি যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে,তাহলে এমন একটা সময় আসে, যখন অগ্নি যাকেই কাছে পায় তাকেই জড়িয়ে ধরে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেয়। ভয়ে পশু পাখিরাও যে যেদিকে পারে পালিয়ে বাঁচে, আর যারা পালাতে পারেনা তারা অগ্নি দেবতার পায়ে নতি স্বীকার করে,অগ্নিতেই মিলিয়ে যায়।

মাওবাদী আন্দোলনের সময় লালগড়ের মানুষের সেই অবস্থায় হয়েছিল।যারা পেরেছিল লালগড় ছেড়ে পালিয়ে ছিল।আর যারা পালাতে পারে নি। তারা একদিকে মাওবাদী দের কড়া  হুকুম আর অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে অত্যাচারিত, নির্যাতিত,লাঞ্ছিত হতে হতে কোনো ক্রমে বেঁচে ছিল।সেই বাঁচাকে আর যাই হোক মানুষের মতো বাঁচা বলে না।সেনা বাহিনীর ভয়ে কোন পুরুষ মানুষ বাড়ির বাইরে পা রাখার সাহস পেত না। মেয়েরা তো আরো ভয়ে ভয়ে প্রতিটা দিন আর রাত কাটাত।.. সে কথা বলতে বলতে লালগড়ের আদিবাসী গ্রামের প্রায় নব্বই বছর উত্তীর্ন গোপাল হেমব্রম এক সময় কেঁদেই ফেলে।বুড়ো মানুষের সেই কান্না, শিশুর কান্নাকেও হার মানায়।


কান্না দেখে লালগড়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করতে আসা হারুন আনসারী প্রথমে হতচকিত হয়ে পড়ে। একটা মানুষকে হাসতে বললে হাসতে পারে বটে,কিন্তু কাঁদতে বলতে কেউই কাঁদে না।  হাসা যত সহজ কাঁদা ততই কঠিন কাজ।এ কথা মনে হয় কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, মানুষ খুব দুঃখ না পেলে  কখনোই কাঁদে না। কিছু কিছু অতীত স্মৃতি আমাদের মনোরাজ্যে উদয় হলে, আমরা কখনো হাসি আবার কখনও কেঁদে ফেলি। বিশেষ করে সেই স্মৃতি যদি বিষদঘন হয়,তবে আমাদের দুচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে বৃষ্টিপাতের মতোই অঝোরে ঝরতে থাকে।
টিনের চালা ঘরে তক্তপোষ এর উপর বসে থাকা,বুড়ো মানুষটিকে দাদু সম্বোধন করে, হারুন এই অসময়ে কান্নার কারন জানতে চাই।


গোপাল হেমব্রম বাঁধ ভাঙা কান্নার বেগ কোন রকমে দমন করে, একটু ইতস্ততঃ করে বলে, শুন তাহলে, বলি। 
সে সব ঘটনা বহু পুরোনো। তা আজ থেকে আট- নয় বছর আগেকার দিনের কথা। দিনটা ঠিক মনে পড়ছে না। তবুও বলছি। সেই সময় একটাই রাজনৈতিক পার্টি ছিল।কাস্তে -হাতুড়ি -তারা। ওরা বলত আমাদের পার্টি গরিবের পার্টি। তাই গ্রামের সবাই এমনকি আমিও সেই কাস্তে হাতুড়ি তারার পার্টিই করতাম। গ্রামের সবাই গরিব তাই গরিবের পার্টি টাকে খুব ভালবেসে ছিলাম। আর সেই ভালোবাসায় আমার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়ায়।

একদিন মাওবাদীরা গ্রামে এসে সাদা কাগজে আলতা দিয়ে  লেখা পোস্টার দিয়ে জানিয়ে দিয়ে গেল,আগামীকাল রাত্রে গ্রামের স্কুলে সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। না হলে তার পরিণাম খুব করুন হবে। ভয়ে ভয়ে গ্রামের প্রায় সবাই সেই রাত্রে স্কুলে উপস্থিত হয়েছি। মাওবাদী নেতা , নামটা এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না।তাই বলতে পারছি না। নেতাটি  গ্রামের সবাইকে গরিবের পার্টি ছাড়তে অনুরোধ করে যা বলেছিল,তার সারমর্ম হল,....কাস্তে-হাতুড়ি-তারার পার্টি এখন আর গরিবের পার্টি নয়। তারা পুঁজিপতি, শিল্পপতি, টাটা,বিড়লা, আম্বানিদের দালাল। গরিবের সরকার আমাদের বন জঙ্গল জমি কেড়ে নিতে চাই।  আমাদের বিতাড়িত করে, সেই জমি জলের দরে গরিবের রক্ত চুষে যারা আজ বড়লোক হয়েছে,সেই টাটা, বিড়লা কোম্পানির হাতে তুলে দিয়ে চাই। আমাদের সংগ্রাম সেই সব মানুষদের সাথে যারা গরিবকে শোষণ করে, বা শোষণ করতে সাহায্য করে। আমাদের সংগ্রাম তাদের বিরুদ্ধে যারা গরিবকে ঠকিয়ে, ভুল বুঝিয়ে দিনের পর দিন ফুলে ফেঁপে উঠছে।  তাই সকলেই আমাদের মাওবাদী আন্দোলনকে সমর্থন করো। 
....না। আমি সমর্থন করতে পারি নাই। প্রকাশ্যেই মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম,যতদিন বাঁচব গরিবের পার্টি করব।রাগে,ক্ষোভে, দুঃখে,গোপাল হেমব্রম দাঁত কিড়মিড় করতে করতে খুব জোরের সাথে কথাগুলো বলে ফেলে।
হারুন এতক্ষন একমনে দাদুর কথা শুনছিল। কিন্তু দাদুর চোখে মুখের হঠাৎ অভিব্যক্তির পরিবর্তন তার মনে ভয়ঙ্কর ঠেকে। সে বুঝতে পারে না, দাদুর ক্ষোভটা কার বিরুদ্ধে? হারুন ঢোক গিলে তাড়াতাড়ি বলে, তারপর কি হল?
...তারপর মাওবাদীরা আমাকে সেখান থেকে রাতেই তুলে নিয়ে গভীর জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
...প্রতিবেশীরা কেউ বাধা দেয় নি।ভয়ে ভয়ে দুরু দুরু বক্ষে হারুন মৃদু সুরে বলে।
...সেখানে হাজার খানেক মানুষ থাকলেও কেউ এগিয়ে এলো না। আমার জানা,চেনা প্রতিবেশীরা কেউ বাধাও দিল নি। তবে বাধা দিয়েছিল আমার ছেলে বিমল।
...বিমল! হারুন অস্ফুট স্বরে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে থেমে যায়।
...হ্যাঁ। বিমল আমার ছেলে। সে বলেছিল, " বাবা যদি ভুল করে থাকে তার বিচার এখানেই হোক।" মাওবাদীরা তার কথায় কোনো কর্ণপাত করে নাই।

                       ***************(2)****************
বিমল হেমব্রম সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষায় সফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চমাধ্যমিক এ বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়েছে। গ্রামের মধ্যে সেই সবথেকে মেধাবী ছাত্র ।আদিবাসীদের মধ্যে সংখ্যাধিক্যই  খুবই গবির। তারা জঙ্গলের উপরেরই নির্ভরশীল।জঙ্গলের শাল পাতা বাড়িতে এনে সেই পাতায় থালা তৈরি করে ।জঙ্গলের কাঁচা কাঠ কুড়ুল দিয়ে কেটে মহিলারা মাথায় করেই  সাত আট কিলোমিটার পথ তপ্ত রৌদ্রে হলেও খালি পায়ে হেঁটে বাজারে বিক্রি করে আসে। জঙ্গলের কেন্দু পাতা সংগ্রহ করে এবং সেইগুলি  বাজারে বিক্রি করে দুটো টাকার মুখ দেখে। তাছাড়া টাকা উপার্জনের আর কোন পথ নেই। তাই দারিদ্র আদিবাসী পরিবার গুলির নিত্য সঙ্গী। সংসার চালাতে  খুব কষ্ট হলেও বিমলকে পড়াশুনা করতে সর্বদা সাহস জুগিয়ে গেছি। কোনো কোনো দিন হয়তো অনাহারে,অর্ধাহারে কেটেছে বটে,কিন্তু বিমল লেখাপড়া করে চাকুরী পাবে,অনেক টাকা রোজগার করবে ভেবে সেই অনাহারে,অর্ধাহারে কাটানোর দুঃখটা নিমিষেই উধাও হয়ে যেত।....বলেই গোপাল হেমব্রম চুপ করে যায়।

.....হারুন দাদুর কথা শুনতে শুনতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। ।তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে  বলে, দাদু তোমাকে যে, মাওবাদীরা তুলে নিয়ে গেল, তারপর কি হল?

....গোপাল হেমব্রম দুই চোখ একটু বন্ধ করে, আবার চোখ খুলে বলে, ..
ও ,হ্যাঁ। সে কথাও বলছি।সেদিন ওই গভীর জঙ্গলের মধ্যেই রাত্রি অবসান করে নব প্রভাতের স্বাদ নিয়েছি। অমাবস্যার রাত্রি ছিল বলে ঠিক জঙ্গলের কোথায় তাদের আস্থানা তা আমি আজও হাজার মনে করলেও বুঝতে পারি নাই। তবে সেখানে কম করে হলেও  ত্রিশ চল্লিশ জন মাওবাদী উপস্থিত ছিলেন।আমি কারও নিমক খায় নি তাই ভুল বলব না। সেখানে উপস্থিত কেউই আমার সাথে কোন রূপ খারাপ ব্যবহার করে নাই। আমার হাতে বা জঙ্গলে কোনো ঘড়ি ছিল না বলে টাইম টা ঠিক বলতে পারছি না। তবে রাত্রি দশটার কম কিছুতেই হবে না।একজন মধ্যম বয়সের মাওবাদী আমাকে কাছে ডেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলে, যা আমি আজও ভুলি নাই।
.....হারুন তাড়াতাড়ি উৎসহভরে বলে ,দাদু...কি কথা?বল।বল।

মাওবাদীরা বলেছে, তারা কখনও সাধারন মানুষের ক্ষতি করে না। শিশু ও মহিলার ক্ষতি করে না। তারা সমাজের অন্যায় অচ্যাচার, শোষণ বঞ্চনা নির্মূল করে এক সুন্দর,সাম্য সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখে। কখনোই হিংসার আশ্রয় নেয় না। তবে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আঘাতের উপযুক্ত জবাব দিতে বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য হয়েছে। সেদিন অনেক কথায় শুনিয়েছে, সব কথা আমার আজ আর মনে নেই।
শেষে আমাকে অভয় দিয়ে বলে, আমি যেন তাদের কখনও ভয় না করি। কিছু শুকনো খাবার আমাকে দিয়ে ,ওরাও আমার সঙ্গে খায়। তারপর যখন যে ওই নির্জন গভীর অরণ্যে খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়ে পড়েছি, আমার মনে নেই। সকালে গোলা গুলির প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভাঙলে এক মাওবাদী আমার দুই চোখ গামছা দিয়ে ভালো করে বেঁধে,গম্ভীর ভাবে বলে, গামছা খোলার চেষ্টা করবে না। আমার হাত ধরে ধরে এসো।


একবার ভাবলাম আজই আমার শেষ দিন। ভয়ে ভয়ে ঐ ব্যক্তির হাত ধরে গভীর জঙ্গলে ঘন্টা খানেক হাঁটার পর একসময় সে আমার হাতটা হেঁচকা দিয়ে বলে, দাঁড়াও।
আমার গামছা খুলে দিয়ে মাওবাদী ছেলেটি বলে, এরপর বাড়ি যেতে পারবে তো?
...স্বস্তির নিঃশাস ফেলে,তাড়াতাড়ি বলি,পারব।
সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি চলে আসি।.......
ইতিমধ্যেই গোপাল হেমব্রমের স্ত্রী  চা খাবার নিয়ে এলে গল্পে একটু ছেদ পড়ে।গল্পটা শুনতে হারুনের ভালোই লাগছে,তাই চায়ের কাপটা হাতে ধরেই হারুন বলে, দাদু তারপর কি হল? 
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে  বলে, আগে গরম গরম  চা টা তৃপ্তি ভরে খাওয়া হোক তারপর বলছি। 


                              ************(3)************
চা খাওয়া পর্ব সমাপ্ত হলে স্ত্রীকে ডেকে চায়ের কাপ দুটি তাঁর হাতে দিয়ে বিদেয় করে বলে,বাড়ি এসে শুনছি, এলাকায় মাওবাদী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে,আধা সামরিক বাহিনী এসে গ্রামে খুব তান্ডব চালিয়েছে। যদিও এর আগেও বিনা দোষে সি আর পি এফ জওয়ানরা গ্রামবাসীদের মারধর করেছে। তবে দিন কয়েক আগে শালবনি দিকে মাওবাদীরা ল্যান্ড মাইন ফাটালে কোন এক বড় নেতা নাকি অল্পের জন্য জীবনে বেঁচে যায়।

তারপর থেকেই  নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অচ্যাচার নেমে আসে। কিন্তু সহ্যের একটা সীমা আছে, রাবারকে ধরে যদি ক্রমাগত টানা হয় তাহলে একটা সময়ে সেই রাবার ছিঁড়ে যায়। অত্যাচারিত মানুষও অচ্যাচার সহ্য করতে করতে যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তখন ঘুরে দাঁড়ায়। প্রতিবাদ করে। লালগড়ের সাধারণ মানুষও প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছে।নারীদের যতই অবলা,বলা হয় না কেন, তারা যদি একবার হাতে অস্ত্র ধরে,পৃথিবীও কেঁপে ওঠে। নারীরা ঘরে বসে না থেকে পুরুষের পায়ে পা মিলিয়ে প্ৰতিবাদ করে। আর তখনই রাজ্যের শাসকদল,এমনকি সরকার পর্যন্ত ভয় পেয়ে যায়। খবর আসে, ছোটপেলিয়া গ্রামে প্রতিবাদী মানুষের মিছিলের উপর পুলিশ বাহিনী হামলা চালায়। নির্যাতনের হাত থেকে মেয়েরাও ছাড় পায় নি। সেনা বাহিনী মহিলাদের উপর কি রকম শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছিল, তাঁর জলন্ত প্রমান সীতামনি মুর্মু ।পুলিশ তাঁকে চুলের মুঠি ধরে আছড়ে মারে। বন্দুকের বাট দিয়ে গুঁতিয়ে  সীতা মনির একটা চোখ কানা করে দেয়। 
... হারুন ।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তারপর?

তারপর এই পুলিশের  অন্যায়, অচ্যাচার, দমন পীড়ন দেখে লালগড়ে গড়ে ওঠে "পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কমিটি" । এই কমিটি লালগড় আন্দোলনের পুরোভাগে নেতৃত্ব দেয়। টেলিভিশন এর কল্যানে লালগড়ের আন্দোলন সারা পৃথিবী দেখে। রাস্তা কেটে, পথে গাছের গুঁড়ি ফেলে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট। আমার ছেলে বিমল হেমব্রমও সেই আন্দোলনে যোগদান করে।

জনসাধারণের আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে সরকারের চেষ্টায় লালগড়,কাঁটা পাহাড়ি,ধরমপুর, কলাইমুড়ি, রামগড় অঞ্চলে পুলিশের বিশাল ক্যাম্প বসে। তাছাড়া সকরারী হাসপাতাল,স্কুল,অফিসের ঘর দখল করেও পুলিশ ক্যাম্প করে।চারদিকে পুলিশ ধরপাকড় শুরু করে। ভয়ে ভয়ে লালগড়, ধমপুর,বইতা, ঠাকুরপাড়া, চাঁদাবিলা,পূর্ণপানি, ভোলাগাড়া  বীরকাড়, আমলিয়া ,আজনাসুলি, আরো কত গ্রামের মানুষ দিন কাটায়। কখন যে কি হয় সেই অজানা আতঙ্কে সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়।রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ সাধারণ মানুষকে ধরে মারধর করে। ঘরে বন্দি থাকার ফলে  বাজার হাট করাও বন্ধ হয়।ওদিকে মাওবাদীরা শাল গাছের গুড়িতে পোস্টের সেঁটে জানান দেয়, বাড়িতে বাড়িতে অরন্ধন কর্মসূচি পালন করতে হবে। 
হারুন আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, তারপর? তারপর?

তারপর, একদিন পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কিমিটি হাজার হাজার মানুষের মিছিল করে, থানায় তেরো দফা দাবি পেশ করে। 
হারুন কৌতূহলের সাথে জিজ্ঞাসা করে,...দাদু ! সেই দাবি গুলি কি ছিল?
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে, তারপর বলে, সেই দাবি গুলি আজ সব আমার মনে নেই। তাছাড়া আমি কেন,কেউই মনে হয় আজ আর বলতে পারবে না। তবে কয়েকটি দাবি আজও মনে আছে।যা শুনলে তুমিও হাসবে! এক, দুই করে বলছি....
এক)প্রথম দাবিটি থানার এস পি- কে কানে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে। আর বলতে হবে আজ থেকে জনসাধারণ ও মহিলাদের বিশেষ করে গ্রেপ্তার ও অচ্যাচার বন্ধ করছি।
দুই) যে পুলিশ কর্মীরা ছোটপেলিয়ে গ্রামে মহিলাদের উপর  শারীরিক অত্যাচার করে,এমনকি মহিলার চোখ পর্যন্ত মেরে কানা করে দিয়েছে, তাদের  দলিতপুর চক থেকে ছোটপেলিয়া গ্রাম পর্যন্ত নাকখত দিতে হবে।
তিন) এলাকার জনসাধারনকে যখন তখন মাঠে, ঘটে,বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেপ্তার করা বন্ধ করতে হবে।
তাছাড়াও আরো কিছু দাবি ছিল। যে দাবিগুলো এলাকার সাধরন মানুষের সাথে জড়িত ছিল। 


হারুন একনাগাড়ে শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সে ভাবে এ গল্পের মনে হয় শেষ নেই।তাই একটু অধর্য্য হয়ে বলে,দাদু! গল্পটা আর এতটা আছে?
গোপাল হেমব্রম একটু হেসে তাড়াতাড়ি বলে, এর একটু।যখন এতক্ষন শুনতে পারলে তখন শেষটা শুনেই যাও। 

 অফিস টাইমে শিয়ালদা রেলস্টেশনে কোনো লোকাল প্যাসেঞ্জার থামলে নিত্যযাত্রীদের মধ্যে গাড়িতে উঠার জন্য যেমন হুড়োহুড়ি পড়ে, তারপর চলন্ত গাড়ির মধ্যে প্যাসেঞ্জাররা ঠেলা ঠেলি, মারামারি করতে লাগে, তেমনি লালগড়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যখন চূড়ান্ত উদ্যমে চলছে তখন পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জন সাধারণের কমিটিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে। কিছু স্বার্থান্বেষী, সুযোগসন্ধানী মানুষ সেই কমিটিতে ঢুকে লালগড়ের আন্দোলনের বারোটা বাজিয়ে দেয়।জানো,হারুন,....কিছু বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর সব জায়গাতেই আছে। তাঁদেরই সহযোগিতায় সাংবাদিক ছদ্মবেশে পুলিশ, লালগড় আন্দোলনের,তথা পুলিশী সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির লড়াকু সর্বজনপ্রিয় নেতাকে গ্রেপ্তার করে।সেই নেতার নামটা নিশ্চয় আজ আর নতুন করে বলে দিতে হবে না । আজ সারা বাংলা কেন, সারা ভারতের মানুষ জেনে গেছে। তারপর লালগড়ের জনগনের সেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষন চুপ থেকে গোপাল হেমব্রম আবার ডুকরে কেঁদে ওঠে। 
হারুন কান্না দেখে হতভম্ব হয়ে যায়। আবার কি হল?  সান্ত্বনা দিয়ে বলে, দাদু। চুপ করো।....
...হারুনকে থামিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দাদু বলে, চুপ করো, বললেই আমি কি চুপ থাকতে পারি? লালগড়ের আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে পড়েছে,তখনই একদিন গভীর রাতে পাঁচ সাত জনের একটি দল কালো কাপড়ে মুখ ঢেকে, আমার একমাত্র ছেলে বিমলকে  তুলে নিয়ে গেল।
...তারপর বিমলের কি হল? হারুন তাড়াতাড়ি বলে।
বৃদ্ধ গোপাল হেমব্রম চোখের জল মুছতে মুছতে বলে,তারপর।...আজ প্রায় নয় বছর হল। আমার বিমল এখনো পর্যন্ত বাড়ি ফিরে আসেনি।প্রশাসনের দরজায় দরজায় বহু বছর ঘুরেছি। কিন্তু আমার ছেলে বিমল হেমব্রম এর কোন সন্ধান কেউ দিতে পারে নাই।আজও আমি তাঁরই আশায় সকাল সন্ধ্যা পথ চেয়ে বসে আছি.......

হারুন সাহস করে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না ,আর গোপাল হেমব্রম মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে।পাখির কিচিরমিচির কলরব কানে প্রবেশ করে জানিয়ে দেয় সন্ধ্যা হয়ে গেছে।


            
(বি:দ্র- গল্পের সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক)
15/09/2019



স্বার্থপর




যে যাই বলুক, কলেজ লাইফে ক্যাম্পাসে বসে বন্ধু বান্ধবীদের নিয়ে একসাথে  আড্ডা দেওয়ার আনন্দই আলাদা।  যারা শুধু পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে, একদিনের জন্যও জমিয়ে আড্ডা দিয়ে পারে নাই তাদের জীবনটাই বৃথা।
কি বলিস রে পচা! তাই না? কলেজ ক্যাম্পাসে পাশাপাশি বসে থাকা পচার পিঠ টা আদর করে চাপড়াতে চাপড়াতে বলে ধনা।ধনার ভালো নাম ধনঞ্জয়।
...তা কিছুটা হলেও সত্য বটে।তবে সবটা নয়।উদাস মনে বলে পচা। 

ধনা, পেন্টের পকেটে লুকিয়ে রাখা সিকারেট বক্সটি আস্তে আস্তে বার করে। সিকারেট খাওয়া তার বহুদিনের অভ্যাস। না খেলে মনটা কেমন খুত খুত করে। কোনো কাজেই তাঁর মন বসে না। এই নিয়ে বাড়িতে বাবার কাছে কম বকুনি খেতে হয় নাই। ক্লাস সিক্স কি সেভেন হবে ,ঠিক মনে নেই।একবার তো সিকারেট খাওয়ার অপরাধে তার বাবা হাত পা দড়ি দিয়ে বেঁধে মেরে মেরে আধ মরা করেছিল। ধনার মা না থাকতে বোধহয় মেরেই ফেলত। মায়ের চেষ্টায় সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিল।তবুও সে শিক্ষা পায় নি।সিকারেটের বক্সটি খুলে একটি সিকারেট বের করে মুখে দেয়। দেশলাই বের করে সেই আগুনে সিকারেট টি সে ধারায়। 
তারপর একবার মনের আনন্দে টান দিয়ে মুখ ভর্তি ধোঁয়া  উপরের দিকে মুখ করে ফুঁ দিয়ে, একটা তৃপ্তির হাসি হেসে বিজ্ঞ জনের মতো  বলে, জানিস,পচা। সবাই স্বার্থপর রে। পৃথিবীর সবাই আর্থপর। বলেই আর একটা টান দেয়।

পচা,ধনাকে ভালো ভাবেই চিনত।বছর তিনেক আগে তাদের পরিচয় হয়।  কোনো জাদুতে যে দুই জন বিপরীত মেরুর বাসিন্দা,বন্ধুতে পরিণত হয় সেই জাদুর কথা,পচা আজও ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারে নাই। ধনার সাথে তার স্বভাবে মিলের থেকে আমিলই দেশি। পচা মাধ্যমিক পাস করে ধনাদের স্কুলে এসে ভর্তি হয়েছিল।তাদের দুজনের বাড়ি স্কুল থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে হলেও কেউ কাউকে এর আগে চিনত না।উচ্চমাধ্যমিক থেকে আজ পর্যন্ত সেই গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব  অটুট আছে। যদিও স্কুলে দুজনের মধ্যে একবার একটু মনোমালিন্য হয়েছিল বটে,তবে সে মনোমালিন্য বেশি দূর গড়ায় নি।
পচা একটু হেসে বলে, সবাই স্বার্থপর নয় রে! কেউ কেউ স্বার্থপর!

...তাড়াতাড়ি মুখ ভর্তি সিকারেটের ধোঁয়াটি উপরের দিকে ছেড়ে দিয়ে গম্ভীর গলায়  ধনা বলে,লাল্টু,পল্টু,বিকাশ, আকাশ......কাকে, ভালো বলব?তুই-ই বল দেখি! শালারা কেউ সম্পর্ক টুকুও আজ আর রাখে না।
...ওরা না রাখুক। তোরও তো সম্পর্ক রাখা উচিত ছিল।
...জোরে একবার টান দিয়ে,অবশিষ্টাংশ সিকারেট টি কলেজ ক্যাম্পাসে চিরসবুজ ঘাসের উপর ছুঁড়ে দিয়ে,পচার প্রশ্নটি কৌশলে এড়িয়ে,জলন্ত সিকারেট এর উড্ডীয়মান ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে তাকিয়ে,মুখটা বিকৃত করে বলে, যাক।তাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম ।কিন্তু নীলিমার কথা?সে কি স্বার্থপর নয়। তাকে স্বার্থপর বলব ,না তো আর কাকে স্বার্থপর বলব?

...পচা, ধনা-নীলিমার অতীত ইতিহাস সবটা না জানলেও কিছু কিছু জানে। তাই শুধু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
ধনা, একবার শরতের পরিস্কার আকাশের ভাসমান ছোট ছোট মেঘের ভেলায় দিকে তাকায়।তারপর ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসের দিয়ে তাকিয়ে বলে, নীলিমা কি আমার জন্য একটি বছর অপেক্ষা করতে পারত না?
...পচা,মানে পঞ্চানন বাউরি। কোনদিনই কারো সাতেপাচঁ এ থাকে নাই।খুবই সাধারণ সহজ,সরল ছেলে।তবুও সে বলে, নীলিমার দোষ দেওয়া বৃথা।তার কি দোষ? তার বাবা.....
...থাক ।তোকে আর তার হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। বলেই মুখে ভেংচি কেটে বিরক্তির সুরে বলে, তার বাবা।যতসব.....।সে ইচ্ছা করলে বাবাকে বোঝানো কি এমন কঠিন কাজ ছিল?পৃথিবীতে এমন কোনো কাজ নেই, যা ইচ্ছা থাকলে করা যায় না।

দু জনেই একটুক্ষন চুপচাপ থাকে। কেউ কথা বলে না।। অজানা কারণে দুজনেই নীরবতা পালন করে। গাছের নিচে বসে থাকা ধনার মাথার উপরে কি একটা পড়ল। ধনা,তাড়াতাড়ি মাথায় হাত বুলিয়ে নীরবতা ভঙ্গ করে,গাছের  উপরের দিকে তাকিয়ে কয়েকটি পাখিকে লক্ষ্য করে ,বিরক্তির সুরে বলে, শালা, এদের জ্বালায় দুদন্ড যে বসে আরাম করবি।তাও হবে না। সব শালা স্বার্থপর! কেউ কম যায় না।
পচা, ধনার মাথার দিকে তাকিয়ে একটু হাসব হাসব করে,কিন্তু মুখের দিকে তাকাতেই সেই হাসি কোথায় হারিয়ে যায়। সে আর হাসতে পারে নাই। এতদিন ধনাকে সে কাছ থেকে দেখছে,কিন্তু তাঁর মুখের রূপ যে,এমন দেখতে হবে,তা ইতিপূর্বে কোনোদিন দেখে নাই। খুব দুঃখ পেলেও কোনোদিন তাঁর মুখটা এমন পাংশু,বিবর্ন হয় নাই।


...ধনা, আরেকটা সিকারেট পকেট থেকে বার করে ধারায়।,একটাছোট্ট টান মেরে বলে, আমি কি নীলিমাকে ভালোবাসি নাই? নিজের জীবনের চেয়েও তাকে অনেক বেশি ভালো বেসেছি ।তাঁর জন্য আমি কি করি নাই? সব করেছি।
একটা জোরে  দীর্থশ্বাস ফেলে আবার বলে, যেদিন  ক্লাসের জানালায় চাপা পড়ে তাঁর হাত কেটে ঝর ঝর করে রক্ত বের হয়ে ছিল,সেদিন কে এগিয়ে এসেছিল? এই ধনা-য়, সেদিন রুমাল দিয়ে হাতটা শক্ত করে বেঁধে দিয়েছে। সে কথা নীলিমা কি করে ভুলে গেল? আর ভুলবেই না কেন? যারা স্বার্থপর হয় ।তারা সব কিছু ভুলে যায়। শুধু নিজের স্বার্থ টা কখনো ভুলে নাই। নীলিমা তাদেরই প্রতিনিধি।


...পচা, এতবড় অভিযোগের কোন উত্তর না দিয়ে, অতীত স্মৃতির অন্তরালে একটু উঁকি দেয়,....
নীলিমা স্কুলে পড়াশুনায় কোনোদিন ই প্রথম হতে পারে নি ঠিকই তবে দেহের রূপ যৌবনের সৌন্দর্য্যে গোটা স্কুলের ছাত্রীদের পিছনে ফেলে বিনা বাধায় প্রথম স্থানটি অধিকার করতে পারে। দেখতে বিশ্বসুন্দরী না হলেও অতীব সুন্দরী এ কথা স্কুলের ছাত্র থেকে মাস্টার মশায় কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। বসন্ত কালে গাছের প্রস্ফুটিত ফুলের পরিমল সিঞ্চনের জন্য যেমন মৌমাছির ঝাঁক সেই ফুলের চারপাশে ঘুর ঘুর করে, তেমনি নীলিমার অনন্ত রূপরাশির তীব্র আর্কষনে স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে সমুদ্রের স্রোতের মতো শিক্ষক মশায়দের দৃষ্টির অন্তরালে প্রবল প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। সেই প্রতিযোগিতায় সকলকে পিছনে ফেলে ধনঞ্জয় জয়ী হয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের শেষে নীলিমার নরম কচি হাতটি ধনায় এক সময় পরম আদর যত্নে ধরে। প্রথম থেকে  শেষ পর্যন্ত এই চিত্রনাট্যের একমাত্র ভালো দর্শক পচা।

ধনঞ্জয় যেমন নীলিমাকে ভালোবাসে, তেমনি নীলিমা ও ধনাকে ভালোবাসে। এতে স্কুলের  কিছু ছেলে হিংসায় জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যেত। কিন্তু নীলিমা তা গ্রাহ্য ই করত না।দেখেও না দেখার ভান করত।

গত বছর স্কুলের সরস্বতী পূজোর দিন। স্কুল থেকে পচা, ধনা,আর নীলিমা পার্কে যায়। সেদিনই তারা প্রথম স্কুল পালিয়ে পার্কে আড্ডা দেয়। সেখানে নীলিমার প্রস্ফুটিত যৌবনের প্রথম অধর সুধা পান করে ধনঞ্জয়।নীলিমা ধনঞ্জয় এর হাতটি বুকে ধরে কম্পিত ঠোঁটের স্পর্শে আলপনা এঁকে বলেছিল."সারা জীবন আমি তোমারই থাকব।পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারবে না।"সেই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী পচা।
...কি রে পচা? তুই কিছু বলবি নাই? দোষটা কি আমার ছিল? না, নীলিমার ছিল?  পিঠে হাত দিয়ে পচার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ধনঞ্জয়।
....দেখ,ধনা। আমি বিচারক নয়। তবেএইটুকু  বলতে পারি, দুজনেরই কিছু কিছু দোষ আছে। এক দশে কখনই কুড়ি হয় না। কারো দোষ কম।কারো দোষ বেশি।এই যা পার্থক্য।
মনে মনে বলে, যখন নীলিমার বিয়ের দেখাশুনা চলছে। বাড়িতে বলেছে উচ্চমাধ্যমিক পাস করলেই বিয়ে দেবে। সে খবর নীলিমা কাঁদতে কাঁদতে ধনঞ্জয়কে জানিয়েছিল। তাঁর দোষ দেওয়া আজ বৃথা। বাড়ির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস ক জনেরই  বা আছে?তবুও নীলিমা তাদের ভালোবাসার কথা মুখ ফুটে বাড়িতে জানিয়েছিল। সে সব কথা ধনঞ্জয় জানত।কিন্তু বাড়ির লোক যদি....
....তুই ও শেষে আমার দোষ দেখতে পেলি রে?আক্ষেপের স্বরে বলে ধনা।
....শুন ভাই। দোষ কোনোদিন চাপা থাকে না।
....সব দোষ আমার। সে বিয়ে করল।কিন্তু,আমাকে বিয়ের নিমন্ত্রণ কার্ড পর্যন্ত দিল না। তবুও সব দোষ আমার ।ধনঞ্জয় উদাস সুরে কথা গুলি বলে।
....তুই সব দোষ নিজেই নিয়ে নিচ্ছি। আমি তা কখনও বলি নাই ।আর হ্যাঁ। নীলিমার অন্তঃত নিমন্ত্রণ করাটা উচিত ছিল।.....

হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে ধনা বলে, আরে চল। চারটা বেজে পেরিয়ে গেছে। টিউশনি আছে। ....

হেঁটে দুজনেই কলেজ গেটের সামনে এসে উপস্থিত হয়।তারা দুজনেই একই মাস্টারের কাছে একই সময়ে  টিউশনি পড়ে। টিউশনি দেরিতে পৌঁছলে মাস্টার আর ঢুকতে দেয় না। তাই একটু ভয়ে ভয়ে আছে।একটু পরেই ধনা, পচাকে ছেড়ে একজন পরিচিত বন্ধুর বাইকে উঠে বসে।

পচা করুণ গলায় বলে, আমি কিসে যাব রে ধনা?
...ধনা,একটু মৃদু হেসে বলে, সে আমি জানি নাই। আমি কি ঠিকেই নিয়েছি নাকি?বলতেই  গাড়ির ড্রাইভার  একগুচ্ছ ধূলো বলি উড়িয়ে পচা কে অভ্যর্থনা জানিয়ে বিদায় নিল।

...পচা, চলে যাওয়া গাড়িটির কালো ধোঁয়ার কুন্ডলীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে, একা দাঁড়িয়ে অস্ফূর্ত স্বরে একটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে থেমে গেল ।সেই একটিমাত্র শব্দটি হল "স্বার্থপর"।

20/09/2019






পূজোর উপহার


 

রাগে গজ গজ করতে করতে বিকাশ ঘর থেকে না খেয়ে বেরিয়ে গেল। রাগের বশে ছাতাটাও নিতে সে ভুলে যায়।এখন বর্ষা কাল।সে  ঊর্দ্ধগগনের পানে তাকিয়ে বলে,এখন যদিও আকাশে তেমন মেঘ নেই বটে কিন্তু বর্ষাকালের মেঘ কাউকে বলে কয়ে আসে না। আর যখন আসে তখন অকাতরে বৃষ্টি দান করে চলে যায়। যার দরকার তাকেও দেয়, আর যার দরকার নেই তাকেও দেয়।ধনী গরিব সে মানে না। মেঘের কাছে সবাই সমান।বাড়ি থেকে কয়েক পা হেঁটে সরু গলিতে পৌঁছেই দেখে, তিন চারটি সারমেয় ফেলে দেওয়া এঁটো পাতার অধিকার নিয়ে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়েছে। পৃথিবীতে মনে হয় কেউ কাউকে বিনা লড়াই- এ এক চুলোও অধিকার ছেড়ে দেয় না। লড়াই করে অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। এটা পশুরাও জেনে গেছে।আর পৃথিবীর শ্রেষ্ট প্রাণী মানুষ! হা হা হা !বিকাশ নিজের মনেই হেসে ফেলে। 
রাস্তা দিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর খগেন কাকার হোটেল আছে। বিকাশ একবার হোটেলের উনুনে চাপা হাঁড়িটার উড্ডীয়মান বাষ্প রাশির দিকে তাকিয়ে ভাবে, একটু গরম গরম ডাল ভাত খেয়ে নিলে ভালো হয়। অফিসে কোনো ক্যান্টিন নেই। হাতে পরে থাকা শ্বশুরের দেওয়া  ঘড়িটির দিকে সে তাকায়। সকাল ন' টা কুড়ি। অফিস বাস সাড়ে ন টায়। হোটেলে ভাত খেলে অফিস পৌঁছতে দেরি হবে। আর দেরি হলে রক্ষে নেই। অফিসের বস নিয়ম করে দিয়েছে দেরি করে এলে মাইনে কাটা যাবে।তাহলে আজকে দিনটি কি উপবাস করে কাটাতে হবে? 



বাড়িতে খেয়ে এলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত!বিকাশ ভাবে,সুতপাকে ওই রকম ভাবে কথাটা বলা তার ঠিক হয় নাই। সুতপা তার বিবাহিতা বৌ। সে কি এমন লাখ টাকার জিনিস চেয়েছিল? যে তাঁকে কড়া কথা শুনিয়ে দিতে হল?আগামী পুজোতে একটি ভালো শাড়ী চেয়েছিল। বেশ এই টুকুই তার চাওয়া।আচ্ছা,সে কি চাইতে পারে নাই? না, তার কিছু চাওয়ার অধিকার নেই? যখন তাকে বিয়ে করেছি,তখন তাঁর সমস্ত দায়িত্ব আমার।আমি না দিলে,সে আর কার কাছে পাবে? তাহলে আজ দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করছি কেন?


বাস স্ট্যান্ড এ ঢুকতেই একটি বাস মাটিতে গড়িয়ে থাকা জলকে বিকাশের গায়ের দিকে ছিটকে দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়ে, বেরিয়ে গেল। পরিস্কার জামাতে নোংরা জল স্টেম হয়ে যায়। এতে তার মনে গাড়ির ড্রাইভারের প্রতি প্রচন্ড রাগ হল বটে,কিন্তু বাসটি চোখের পলকে স্ট্যান্ড থেকে বেরিয়ে গেল বলে, সেই উত্থিত রাগ মনের মধ্যেই পুষে রাখতে বাধ্য হল।।পেন্টের পকেট থেকে রুমালটা বের করে নোংরা জলের দাগ পরিস্কার করতে ব্যর্থ হয়ে,শেষে ড্রাইভার কে বিড়বিড় করে দুটো গালি গালাজ দিয়ে রাগটি কিছুটা হলেও ক্ষান্ত হল।
মাত্র  দশটি টাকা বাঁচবে বলে সে অটো রিকশায় চাপে না।পায়ে হেঁটে এক কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছায়। তারপর বাসে চেপে অফিসে যায়।অবশ্য আজ নতুন নয়। প্রতিদিনই এই ভাবেই যায়। 


যে গাড়িতে করে বিকাশ অফিস যায়,সেই গাড়িটি বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে।গাড়িতে উঠেই দেখে, সব বসার সীট ভর্তি হয়ে গেছে।শুধু মাত্র পিছনের দিকে একটি শীটে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা বসে আছে।
বিকাশ ভদ্রমহিলাকে বৌদি সম্বোধন করে বলে, আপনি জানলা দিকে বসুন।আমি এ দিকে বসছি।
ভদ্র মহিলাটি রুদ্র স্বরে বলে, আমি এখানেই বেশ আছি। আপনি বরং জানলার ধারে গিয়ে বসুন।
বিকাশ একটু অবাক হয়ে ভাবল, জানলার দিকে বসার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়? কিন্তু ভদ্র মহিলা বসছে না কেন? নিশ্চিতরূপে কোনো কারণ আছে। সে কৌতুক করে বলে, কেন বৌদি, জানলার ধারে কোনো বাঘ ভালুক আছে নাকি?
ভদ্র মহিলাটি বিকাশের কথায় রেগে গিয়ে চড়া গলায় বলে, বলছি তো জানলা ধারে বসব না। আপনি বাংলা বোঝেন ...কি নেই?
ভদ্র মহিলার ধমক খেয়ে অগত্যা বিকাশকে জানলা ধারেই বসতে হয়। অন্যদিন সে বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যায়। আজ আর চোখে ঘুম আসছে না। সে ভাবে, সুতপা এখন কি করছে? সেও কি রাগ করে না খেয়ে বসে আছে? কিছুদিন আগে একবার রাগ করে সে তিনদিন খায় নি। তারপর বিকাশ বহু কষ্টে তার রাগ ভাঙ্গিয়েছিল।সুতপা বিকাশকে খুব ভালোবাসে। আদর যত্নে স্বামী সেবায় তার কোন ত্রুটি নেই।তবুও মাঝে মাঝে দু জনের একটু আধটু কথা কাটাকাটি হয়। আর বলতে গেলে কার সংসারে তা হয় না। কারো কম কারো বেশি।
বিকাশ অফিস পৌঁছে গেটের কাছে থমকে দাঁড়ায়। সকাল থেকে একটাও সিকারেট খাওয়া হয় নি। জামার পকেট থেকে একটা সিকারেট রের করে তাড়াতাড়ি ধরায়। অফিসে ধুমপানে নিষেধাজ্ঞা আছে। বার পাঁচেক টান মেরে সিকারেট-টি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া সিকারেটের দিকে তাকিয়ে বলে, মানুষের রাগ টাও যদি ঐ সিকারেট এর মতো পুড়ে শেষ হয়ে যেত। তাহলে সুতপার সাথে তার কোনো দিনই মনোমালিন্য হত না। 


অফিস করে বিকাশ বাড়ি ফেরার বাস ধরে। আজ আর সিটের জন্য ঝগড়া করতে হয় না ।বাসে উঠেই সে সীট পায়। সারাদিন খাওয়া নেই ।দাওয়া নেই ।শরীরটা বড়ই ক্লান্ত মনে হয়। বাসের সীটে কান্ত শরীরটা সে এলিয়ে দেয়। একটু পরেই সামনের সীট থেকে পরিচিত গলার স্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে তার কানে, "বিকাশ তুমি ভুল করছ! তুমি মানুষ, তোমার স্ত্রীও মানুষ। এখানে কেউ বড় কেউ ছোট নয়। ভালোবাসা পেতে হলে ভালবাসা দিতেও হয়। এক পক্ষের ভালোবাসা কখনও চিরস্থায়ী হয় না। সংসার সুখের হয় না।"
কন্ঠস্বর শুনে,বিকাশ সামনের সিটের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু কই? পরিচিত তো কেই নেই!  সামনের দুটো সিটে বসা ভদ্রলোক গুলি ঘুমাচ্ছে। বিকাশের সারা শরীর বিদ্যুতের চমক খেলে গেল। তাহলে কে তাকে এতক্ষন এই কথাগুলি বলল?
সে কি স্বপ্ন দেখছিল? যাই হোক কথা গুলো মন্দ নয়।বাস দাঁড়ালে সে মাঝ পথেই নেমে যায়। তারপর একটি ভালো শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে যায়।

বাড়িতে ঢুকেই দেখে, তার স্ত্রী সুতপার দুই চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। বিকাশের বুঝতে আর বাকি রইল না।সারা দিন কান্না কাটি করে এই অবস্থা হয়েছে।নিজের কৃতকর্মের জন্য তাঁকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে।বিকাশ মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর কোনোদিন স্ত্রীকে বিনা দোষে কষ্ট দেবে না।খাটের উপর বসেই সুতপাকে ডাক দেয়। সুতপা কাছে আসতেই একটু হেসে, মিষ্টি গলায় বলে, দেখো তো তোমার পছন্দ হয়েছে কি না? বলেই শাড়িটি বাড়িয়ে দেয় স্ত্রীর দিকে।

সুতপা শাড়িটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। মুখে কিছু না বললেও তার লালচে অশ্রুসিক্ত চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।রাত্রি হলেও টিউবের আলোয় বিকাশ স্পষ্ট দেখতে পায়।
বিকাশ তাঁর স্ত্রীর চোখের জল শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে, বুকের কাছে টেনে, জড়িয়ে বলে, সুতপা এ শাড়ি তোমার পূজোর উপহার।
17/09/2019


শেষ ইচ্ছা




পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা প্রতিদিনই ভরা বর্ষায় উত্তাল গঙ্গা নদীর জলপ্লাবনের মতো বাড়লেও সেই মানুষ গুলির মধ্যে দৈহিক মিল যেমন নেই, তেমনি তাদের আচার -ব্যবহার, রীতি নীতি, খাদ্যাভ্যাস, এমনকি সবার ইচ্ছা ,আকাঙ্ক্ষাও তারতম্য আমাদের চোখে খুবই প্রকট রূপে ধরা পড়ে।আপাত দৃষ্টিতে, খালি চোখে, প্রতিটি মানুষেই দেখতে অন্য মানুষেরই প্রতিচ্ছবি মনে হতেই পারে।কিন্তু মনে হলেও আমরা কার মনে  কি আছে? তা  কি জানতে পারি? বলতে গেলে আমরা কেউই নিজের মনে কি আছে, বা আমি কি ভাবছি ...শতচেষ্টা করেও তারই কুলকিনারা খুঁজে উঠতে পারি নি ,তারপর আবার অপরের মনের কথা বোঝা! খুব ভালো ভবিষ্যৎ বক্তাও বোধ হয় বলতে পারবে না।
গাছ থেকে পাকা ফল পড়লেই কি সেই পাকা ফল থেকে তখনই নতুন চারা গাছের জন্ম হয়? তা হয়তো সাথে সাথেই হয় না। তবে এ কথা সত্য, সেই ফলের ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় আগামীদিনের নতুন গাছ ঘুমিয়ে থাকে। আলো,বাতাস,উত্তাপের সংস্পর্শে উপযুক্ত আবহাওয়ায় অঙ্কুরোদগম এর মাধ্যমে তা বিকশিত হয়।
নতুনডি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহিদুল ইসলামেরও একটি ইচ্ছা দীর্থ আটাশ বছর চাকুরী কালব্যাপি সুপ্তই ছিল। এতদিনের সুপ্ত ইচ্ছাটা যে কি! তা তার একমাত্র সহ ধার্মিণী সালমা বিবি কেন,কাক পক্ষীও কোনদিনই জানতো না। 
সেদিন মঙ্গলবার। অকালে  মা মরা সাবিনাকে হাতে ধরে হাঁটতে হাঁটতে সালমা বিবি গ্রামের শেষ প্রান্তে গজিয়ে ওঠা বিশাল প্রাসাদসম ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পৌঁছে দিতে চলে গেল।যদিও বাড়ি থেকে স্কুলের দুরত্ব খুব একটা বেশি নয়।পাঁচশো মিটারের মতো হবে। সাবিনা একা একা যেতেও পারবে। কিন্তু কেউ ঠিক করে জানে না, যে কি গূঢ় রহস্যময় কারনে সবারই বাড়ির অবিভাবকরা তাদের ছেলে মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দেয়। তাই সাবিনাকেও তারা পৌঁছে দেয়। মহিদুল হিসেব করে দেখে,তার স্ত্রীর স্কুল থেকে ফিরে আসতে মিনিট কুড়ি লাগবেই। বাড়িতে আর কেউ নেই।বিছানার তলা থেকে এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের পাস বইটা আস্তে আস্তে টেনে বের করে মহিদুল। তারপর একটু ইতস্তত করে, জানলার দিকে একটু উঁকি মেরে, কেউ  ধারে পাশে নেই, এটা নিশ্চিত হলেও সদর দরজাটা ভেজিয়ে দেয়।কিন্তু দরজায় খিল দেয় না।দড়ি বাধা মোটা কাঁচের চশমাটা চোখে দিয়েই, ব্যাঙ্কের পাসবইটা হাতে নিয়ে ভালো করে উল্টে পাল্টে দেখে। 

মনের আনন্দে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে, আর মাত্র কুড়ি হাজার টাকা! তারপরই সে হজ যাত্রা করতে পারবে। তাঁর আর কোনো চিন্তা নেই! বলেই আবার যথাস্থানে ব্যাঙ্কের পাসবইটা রেখে দেয়। দরজার দিকে ফিরে তাকাতেই দেখে তার সহ ধার্মিণী চৌকাঠ ধরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। আদালতে আসামিকে দোষী সাব্যস্ত করে , বিচারক যখন ফাঁসির আদেশ পড়ে শোনায় তখন আসামির মুখটা যে রকম পাংশু বর্ণের দেখতে হয় , মহিদুলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তার কি করণীয় তা ক্ষনিকের জন্য হলেও বিস্মৃত হয়।
সালমা বিবি  স্বামীকে উদ্দেশ্য করে কৌতূহল দৃষ্টিতে বলে, হ্যাঁ গো তুমি কি সত্যিই মক্কায় হজ করতে যাবে?
...হুম।যাবো। বিহ্বলভাব কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে বলে মহিদুল।
কিছু কিছু তীর্থস্থান এই ধরাধামে আছে। ধার্মিকদের দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে একবার পৌঁছাতে পারলে তার স্বর্গের প্রবেশদ্বার কেউ রুদ্ধ করতে পারবে না। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক মহিদুল ইসলামও অন্য আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই সেই বিশ্বাসকে দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে অন্তরের অন্তিম স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। তাই সুদীর্ঘ চাকুরিকাল ব্যাপী সংসারের সমস্ত দায় দায়িত্ব পালন করেও তিল তিল পরিমান টাকা বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই টাকা আজ ব্যাঙ্কে জমা হতে হতে দুই লাখ আশি হাজার হয়েছে।
সালমা বিবি আর চৌকাঠ না ধরে রেখে স্বামীর কাছে আস্তে আস্তে আসে। সু সজ্জিত পালঙ্কের উপর বসতে বসতে একটু হেঁয়ালী করে বলে, সে তো অনেক টাকার ব্যাপার! আমাদের মতো আদর ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবরে কাজ কি?
.... স্ত্রীর প্রশ্নটির উত্তর এড়িয়ে মহিদুল আদরের স্বরে বলে,জানো সালমা। যতদিন চাকুরী করেছি। ততদিন শুধু আমাদের দুই মেয়ের লেখাপড়া, তারপর ভালো ঘর, ভালো বর, দেখে তাদের বিয়ে দেওয়া। আপামর বাঙালির মতো আমিও সেই স্বপ্নই দেখেছি। সে কাজ আমি সাফল্যের সাথে সমাধান করেছি.....
গর্বভরে প্রসন্ন চিত্তে সালমা বিবি জানায়, সে কথা জানি। আমাদের বড় মেয়ে নার্স হয়েছে। আর ছোট মেয়ের জামাই তো তোমার মতোই স্কুলের ....
মহিদুল তার স্ত্রীকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে শুষ্ক  মুখে একটু হেসে বলে, সে নিয়ে আজ আর আমার কোনো দুঃখ, বা কষ্ট নেই। তবে...
....তবে কি?  স্বামীর চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নিচু করে তাড়াতাড়ি বলে সালমা বিবি।
মহিদুল তার স্ত্রীর হাতটা টেনে, নিজের উরুর উপরে ধরে হাতটি রাখে।সালমা বিবির নিচু করে রাখা মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার এতদিন সব ইচ্ছেই আল্লাহ পূর্ন করেছে। শেষ ইচ্ছা একবার মক্কায় হজ করতে যাওয়া। বেশ এই টুকুই আমার শেষ ইচ্ছা।এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্নও বলতে পারো! কখনোই আমি তা প্রকাশ করি নি। আজ শুধু তোমাকেই বলছি। 
..মুখটা তুলে স্বামীর মুখের দিকে তাকায় সালমা বিবি।তারপর দুই হাত তুলে আল্লাহর কাছে দোয়া মাগে,  হে আল্লাহ!তুমি আমার স্বামীর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করো।বলেই স্বামীর পালঙ্ক থেকে উঠে যায়।



                                            ..............( 2)............…
সাবিনার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর, তখন তার মা ইহলোকের সমস্ত মায়া মমতার বন্ধন ছিন্ন করে, সাবিনাকে মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত করে, সেই অসীমলোকে ,না ফেরার দেশে চলে যায়। অবশ্য তার মায়ের আজ দোষ দেওয়া বৃথা। মমতাময়ীর কোন যথার্থ দোষ ছিলও না ।সাবিনার পাষণ্ড, হৃদয়হীন,মদ-মাতাল বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে, একদিন তার মা আত্মহত্যা করেই ,পার্থিব জগতের সমস্ত অন্যায় অত্যাচার থেকে  মুক্তি লাভ পায়।কিন্তু তার সাবিনা? .....
সাবিনার বাবা কতটা হৃদয়হীন, সেটা আরো স্পষ্ট করে প্রতিবেশীরা বুঝতে পারে, যখন তার মরা বউয়ের চল্লিশা, মানে 40 দিন পার না হতেই শহরের এক সুন্দরী মেয়েকে বউ করে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রতিবেশীরা কেউ কেউ আবার বলে, সারা পৃথিবীতে খোঁজ করলেও নাকি এই রকম পাষণ্ড বাপ খুঁজে পাওয়া মুশকিল!  কেউ কেউ আবার ফিসফিসিয়ে বলে, শহরের এই সুন্দরী মেয়েটার জন্যই নাকি সাবিনার মা মরতে বাধ্য হয়েছে। 
সে যে যাই বলুক না কেন। সাবিনা তাদের কথায় কোন কান দেয় না। সে নতুন মা পেয়ে সেদিন খুশিই হয়েছিল। সে প্রথমে ভেবেছিল তার নিজের মা না থাকলেও  নতুন মা তাকে মাতৃস্নেহে আদর যত্ন করে, মায়ের মতই ভালো বাসবে।
কিন্তু তার সেই আশা আর পূর্ণ হল না। কিছুদিন যেতে না যেতেই সে বুঝতে পারে, এই বাড়িতে তার আর কোন অধিকার নেই, আবদার করার জোও নেই।এখন কথায় কথায়, উঠতে বসতে সৎ মা তাকে মারধর করে ।
সে বাবাকে নালিশ করলে মারধরের মাত্রাটা আরো বৃদ্ধি পায় ।তাই সে চুপ করে,মুখ বুজে সব অত্যাচার সহ্য করে যায়।কিন্তু তাঁর জীবনটা এই কিছুদিনই দুর্বিষহ হয়ে ওঠে ।যেদিন সাবিনা প্রথম উপলব্ধি করে যে, তাকে তাঁর জান্নাতবাসী মায়ের রাস্তায় অবলম্বন করতে হবে ।তা ছাড়া আর কোনো রাস্তাই এখন খোলা নেই।সেদিনই তাঁর মামা মহিদুল ইসলাম প্রতিবেশীদের কাছে সবকিছু জেনে শুনে সাবিনাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়।

তারপর আজ পর্যন্ত সাবিনা আর নিজের বাবার বাড়ি দিকে ফিরেও তাকায় না।মহিদুল তার ভাগ্নিকে নিজের মেয়ের মতই ভালোবাসে। নতুনডি গ্রামের একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সে ক্লাস ফোরে এখন পড়াশোনা করে।



                                               .............. (3)...............
বাঙালিরা মাছ খেতে খুব ভালোবাসে কিন্তু খেতে খেতে যদি মাছের কাঁটা গলায় বিদ্ধ হয়। কেমন লাগে? সে অনুভূতি বোধ হয় যার গলায় মাছের কাঁটা লেগেছে, সে ছাড়া আর অন্য কেউ জানে না। যতক্ষণ না সেই কাঁটা গলা বেয়ে উদরে প্রবেশ করছে ততক্ষণ সেই মাছের কাঁটার কথায় সে মনে মনে চিন্তা করে যায়।মহিদুলেরও যতদিন না হজযাত্রা সফল হচ্ছে,  একটাই চিন্তা তাঁর মাথার মধ্যে নদীর জলতরঙ্গের মত এসে ধাক্কা মারছে।কিছুতেই সে ঐ চিন্তা ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারছে না।

মহিদুল পড়ার টেবিলে ঝুঁকে ফাইবারের চেয়ারে বসে পাসপোর্ট এর জন্য ফরম পূরণ করছে ।কিছুটা পূরণ করে রান্না ঘরের দিকে তাকিয়ে ডাক দেয়...সাবিনা!
সাবিনা ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে বসে ড্রইং এর খাতার উপর রঙ পেনসিল দিয়ে একটা মক্কার ছবি অঙ্কন করছে। মামার গলার স্বর কানে যেতেই পেন্সিলটা নামিয়ে জোর গলায় বলে,... 
মামা।আমায় ডাকছো?
...হুম।এক গ্লাস খাবার জল আনো তো মা।
 সাবিনা যেদিন থেকে মামার বাড়ি এসেছে,সেদিন থেকেই এই বাড়ির ছোটখাটো কাজ গুলো মনের আনন্দে সে নিজেই করে ।মামা বা মামী কেউ তাকে কাজ করতে বাধ্য করেনি।তাঁর কাজ করতে  ভালো লাগে, তাই সে করে। সাবিনা ফ্রিজ খুলে বোতলে রাখা ঠান্ডা জল একটি কাঁচের  গ্লাসে ভরে। ফ্রিজটি লাগিয়ে ঠান্ডা জলের গ্লাসটা  মামার হাতে তুলে দিয়ে চুপচাপ অদূরে দাঁড়িয়ে থাকে।
মহিদুল এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানীয় নিঃশেষ করে, খালি গ্লাসটা সাবিনার দিকে বাড়িয়ে বলে,..
 যা একটু জল দিয়ে ধুয়ে, রেখে দে।
মহিদুল এই ছোট্ট ভাগ্নিটিকে নিজের মেয়েদের থেকে একটু বেশিই ভালোবাসে ।হয়তো বা মেয়েটির কোন মা নেই তাই।তাছাড়া এটাও হতে পারে, সাবিনার  বাবা থাকলেও সে বাবা থাকা না থাকা দুই-ই সমান বলে।।সাবিনার বয়স কম হলে কি হবে !  সে কাজে যেমন লেখাপড়াও তেমনি সমান পারদর্শী ।কোন কাজ একবার তার মামিকে করতে দেখলেই সে নিজেও সে কাজটা অনায়াসে করতে পারে ।পাসপোর্ট এর ফর্ম টা পুরোটা ফিলাপ করে ফর্মের একেবারে নিচে স্বাক্ষর করতে করতে মহিদুল আবার ডাক দেয়,...সাবিনা ।
সাবিনা মক্কার ছবিতে লাস্ট ফিনিশিং এর রং করতে লেগেছে ।সেটা হাতে তুলেই সে বলে ..কি মামা ?কিছু বলছো ?
...হ্যাঁ। তোর মামী আছে তো একবার ডাক দেখি ।দরকার আছে ।
সাবিনা খাতাটা হাতে নিয়েই রান্নাঘরে গিয়ে মামীকে ডেকে, সঙ্গে নিয়েই মামার কাছে চলে আসে ।
মহিদুল হাতে ধরা কলমটা ফিলআপ করা পাসপোর্ট এর ফর্মের উপর রেখে তার স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে বলে ,আগামীকালই আমি ফর্মটা পাসপোর্ট অফিসে জমা দিয়ে দিচ্ছি ।আশা করি কয়েকদিন পরেই কাজ হয়ে যাবে।
 সালমা বিবি কিছু না বলে শুধু একটু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দেই।
  কিন্তু সাবিনা কৌতূহলের সঙ্গে বলে,ওটা কিসের ফরম মামা?
... তুই বুঝবি না মা। 
...কেন বুঝবো না?বুঝিয়ে দিলেই বুঝবো মামা।সাবিনা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ।
ক্লাসে শিক্ষক যেভাবে ছাত্রকে বোঝায় সেভাবে মহিদুল সাবিনাকে বোঝায়,...
 যারা নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে কোন কাজের জন্য যায় ,তাদের পাসপোর্ট ভিসা লাগে। এই পাসপোর্ট ছাড়া কিছুতেই অন্য দেশে কেউ যেতে পারে না ।
..কিন্তু মামা সেটা তোমার কি কাজে লাগবে?সাবিনা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসে।
.. দূর পাগলি!  তোকে তো বলাই হয় নাই। আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করতে কিছুদিন পরেই সৌদি আরবের দেশে মক্কায় হজ করতে যাব ।তাই....
 সালমা বিবি হঠাৎ স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলে, একে বুঝিয়ে কাজ নেই ।তুমি বরং মাথা ঠান্ডা করে কি কি করতে হবে সেগুলো করো। বলেই  ঈগল পাখি যেভাবে শিকার ধরে সেভাবে চোখের পলকে  সাবিনাকে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল ।কিন্তু ড্রইং এর  খাতাটা ভুলবশত সাবিনা টেবিলের উপরই রেখে চলে যায় ।

মুহিদুল টেবিলের ওপর ফর্মটা হাতে তুলতে গিয়েই ড্রইং এর খাতায় সাবিনার কচি হাতে সদ্য অঙ্কন করা মক্কার ছবিটার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।ছবিটা দেখে,মহিদুল দুহাতে তুলে বুকে জড়িয়ে নেয়।পরম আনন্দে দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে ।তা মহিদুল ঠিকই টের পায়।
ইসলাম বলছে ,হজ মুসলমানদের জন্য একটি অবশ্যকরণীয় ইবাদত। এটি ইসলাম ধর্মের পঞ্চম স্তম্ভও বটে।তবে সবার জন্য হজ ফরজ নয়। আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম হলে তবেই হজ করা ফরজ ।একদৃষ্টে মক্কার ছবিটার দিকে তাকিয়ে মহিদুল বলে ,এতদিন এখানে যাব যাব করেও আর যাওয়া হয় নি।  টাকার অভাব ছিল ।আজ আর কোন অভাব নেই ।এবার যাওয়া হবেই.... মহিদুলের চোখের সামনে মক্কার ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।



                                                  .............(4).............
সকালে ঘুম থেকে উঠে সালমা বিবি স্বামীকে মনে করিয়ে দিয়েছে আজ পাসপোর্টের ফর্মটা  অফিসে জমা দেওয়ার কথা ।তাই মহিদুল স্নান করে, খেয়ে দেয়ে, সকাল ন,টার মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়।দরকারি জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে দেখে সাবিনাও তার স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে ।তাই মহিদুল তাঁকে কাছে ডেকেই বলে, সাবিনা চল!  আজ আমি তোকে স্কুলে পৌঁছে দিই।
 ..মামার কথায় সাবিনা রুক্ষ চুলের দুদিকে ফুলবাধাঁ বেণী দুলিয়ে খুশি হয়ে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায়।
 কাঁধে ব্যাগ নিয়ে এক হাতে সাবিনার কচি নরম হাতটি ধরে হেঁটে হেঁটে মহিদুল প্রথমেই ভাগ্নির স্কুলে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় ।তারপর ভাগ্নিকে স্কুলে ছেড়ে সেখানে বাস ধরে পাসপোর্ট অফিসে যাবে।সেই মতো কিছুটা হাঁটার পর সাবিনা থমকে দাঁড়ায়। মহিদুল দেখে, রাস্তার ধারে জীর্ণ মলিন বস্ত্র পরা,ছেঁড়া আসনে বসা, একটি ভিখারিকে সাবিনা স্কুল ব্যাগ থেকে দুটি টাকা বের করে দেয়। অবশ্য সাবিনা শুধু আজ নয়, প্রতিদিনই স্কুল যাওয়ার পথে এই দুটি টাকা দান করে, মনে মনে  এক অসীম সুখ  অনুভব করে।ভিক্ষারীর মলিন মুখে হাসি ফুটিয়ে, মামার হাত ধরে আবার হাঁটা শুরু করে।
হাঁটতে হাঁটতে সাবিনা বলে, জানো, মামা । স্কুলের নতুন দিদিমণি একটা গান শিখিয়েছে!
... ভাগ্নির ধরে থাকা কচি হাতটা নাড়িয়ে দিয়ে মহিদুল বলে,.. কি গান রে ?একটু বল,শুনি।
.. তৎক্ষণাৎ উৎসহভরে দিদিমনির কন্ঠ নকল করে, সে হাঁটতে হাঁটতে গানটি গেয়ে চলে..
" জীবন জীবনের জন্যে,
 মানুষ মানুষের জন্যে ,
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?
ও বন্ধু….
মানুষ মানুষের জন্যে,
জীবন জীবনের জন্যে।
একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না?".......
না। সাবিনা গানটি আর শেষ করতে পারে না ।একটি বাইক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সাবিনাকে সজোরে ধাক্কা মারে। সে পিচ রাস্তার উপরেই লুকিয়ে পড়ে। তার স্কুল ব্যাগটি  দূরে ছিটকে গিয়ে এই দৃশ্যের নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে। পরনের  স্কুলড্রেস রক্তে লাল হয়ে সেই রক্ত কালো পিচের উপরে গড়িয়ে যাচ্ছে। মহিদুল কখনোই এত তাজা রক্ত দেখেনি। তাই ভয় পেয়ে যায়। সে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে ।ক্ষনিকের ঘোর কাটিয়ে  লোকজনের সহযোগিতায় নিকটবর্তী নার্সিংহোমে ভাগ্নিকে ভর্তি করে ।চোখের জল মুছতে মুছতে ডাক্তারের কাছে, করজোড়ে অনুরোধ করে, আমার ভাগ্নি কে বাঁচান ডাক্তারবাবু ।আমার ভাগ্নি কে বাঁচান.....

ওটি রুমের পাশেই মহিদুল নিথর পাথরের মূর্তির মতো একা দাঁড়িয়ে থাকে। এক মনে  শুধু আল্লাহকে ডাকে ।কিছুক্ষণ পরে ওটি থেকে ডাক্তার বেরিয়ে মহিদুলকে আশ্বস্ত করে বলে,  পেসেন্টের মাথায় খুব জোরে আঘাত লেগেছে। এখনো জ্ঞান ফেরেনি।
... ডাক্তারবাবু ওকে বাঁচান। ডাক্তারবাবু ওকে বাঁচান। .......হাতজোড় করে বলতে থাকে মহিদুল।
..24 ঘন্টা না কাটলে কিছুই বলা যাবে না ।এই বলে ডাক্তার নিজের কাজে চলে যায়।

 24 ঘন্টা পর সাবিনার একটু জ্ঞান ফেরে ।সে আবোল-তাবোল বকতে শুরু করে। কাউকে ঠিক মতো চিনতেও পারে না। ডাক্তার মহিদুলকে কাছে ডেকে জানায়, পেশেন্টের মাথায় জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে ।অনেক টাকার দরকার হতে পারে।

বাড়ির কাছাকাছি বাজ পড়লে যেমন আমাদের চোখ ক্ষণিকের জন্য হলেও তীব্র আলোকে স্তব্ধ হয়ে যায়, তেমনি ডাক্তারের কথা শুনে মহিদুল স্তব্ধ হয়ে যায়। চারদিকে ঝাপসা দেখে ।অনেক টাকার দরকার। সে কোথায় এখন এত টাকা পাবে? কে তাকে এই দুর্দিনে এত টাকা দেবে ?তারপর ভাবে, তাঁর তো টাকা আছেই ।
না ।না ।সে টাকা তো হজ করতে যাওয়ার টাকা!  দীর্ঘ আটাশ বছর ধরে একটু একটু করে সঞ্চিত করে, সেই টাকা হয়েছে ।সেই টাকা  ডাক্তারবাবুকে দিলে তার শেষ ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যাবে ।না।সেটা কখনোই হতে পারেনা।

 সে আর ভাবতে পারে না ।মাথা ঘুরতে থাকে।সাবিনার  কন্ঠে গাওয়া গানটার কথা মহিদুলের বারবার মনে পড়ে,"মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে.......
 একদিকে তার শেষ ইচ্ছা হজ করতে যাওয়া, অন্যদিকে তাঁর একমাত্র আদরের ভাগ্নি সাবিনার জীবন বাঁচানো। কোন কাজটা তাঁর এই সময় করা উচিত? সে কিছুই ভেবে পায় না।
মা মরা মেয়ে সাবিনার মুখটা  বারবার মহিদুলের চোখে ভেসে ওঠে।সে হয়তো  চিৎকার করে বলছে,"মামা আমাকে বাঁচাও।আমাকে বাঁচাও। আমাকে বাঁচতে দাও ।টাকা থাকতেও আমি কি তাকে বাঁচাতে পারি না?
 না। না।.....এ আমি কি করছি ? "
মহিদুলের মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠে।সে সাবিনার আর্তচিৎকার স্পষ্ট শুনতে পায়। না, আর এক বিন্দু সময়ও নষ্ট করতে চাই না ।।ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে করজোড়ে জানিয়ে দেয়,অনেক টাকা খরচা হলেও সেই টাকার জন্য চিন্তা করবেন না ডাক্তারবাবু। যত টাকা দরকার হয়, আমি দেবো ।শুধু আমার ভাগ্নি কে বাঁচান। আমার ভাগ্নি কে বাঁচান...
... ঠিক আছে, আমরা চেষ্টা করে দেখব। ভেঙে পড়বেন না ।শান্ত হোন।বলেই ডাক্তারবাবু ওটি তে চলে যায়।



                              **********************************
দীর্ঘ 15 দিন ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর মহিদুল ইসলাম প্রায় লাখ তিনেক  টাকার বিল মিটিয়ে সাবিনার মুখে হাসি ফুটিয়ে নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে এলো ।মহিদুলের শেষ ইচ্ছা পূর্ন না হলেও আজ আর তাঁর মনে কোন দুঃখ নেই।সে একজনের জীবন  বাঁচাতে পেরেছে ..এটা ভেবেই এখন সে গর্ব অনুভব করে।মহিদুল সাবিনার  হাতটি ধরে ভূপেন হাজারিকার গাওয়া "মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে,.গানটি  আজ মামা ভাগ্নি একসাথে গাইতে গাইতে নতুনডি গ্রামের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।

13/09/2019