এক-এ চন্দ্র, দুই-এ পক্ষ
....জামাল আনসারী
একটি শিশুর প্রথম লেখাপড়ার হাতেখড়ি বর্ণ পরিচয়। সাথে সাথে শিশুটি বিভিন্ন সংখ্যা গোনা শিখতে থাকে।এ গুলো শিশুর সহজ সরল কোমল মনে এবং বিশ্বাসে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে।এই বর্ণ পরিচয় ও বিভিন্ন সংখ্যা গোনার সময় থেকেই জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুর মনে কিছু আজগুবি, অবিশ্বাস্য, পৌরাণিক ধর্মীয় কুসংস্কারের ধ্যান ধারণা মস্তিষ্কের রন্ধে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। আসুন আমরা খোলামেলা মনে সেগুলো আলোচনা দেখি......
১- এক- এ চন্দ্র।চন্দ্র মানে চাঁদ। আমরা সকলেই জানি আমাদের পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ হল চাঁদ। তাহলে এক-এ চন্দ্র বলতে একটি চাঁদকে বোঝাচ্ছে। এটা ঠিক আছে।কোনো ভুল নেই।
২- দুই-এ পক্ষ। পক্ষ মানে এখানে কোনো বর পক্ষ বা কনে পক্ষের কথা বলা হয়নি,শত্রুপক্ষ, মিত্রপক্ষ নয় ।বাংলা অভিধানে পক্ষ শব্দের অর্থ দেওয়া আছে.."চাঁদের বৃদ্ধিকাল বা হ্রাসকাল (শুক্লপক্ষ, কৃষ্ণপক্ষ); প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা বা অমাবস্যা তিথি পর্যন্ত সময়; মাসার্ধ, পনেরো দিন (তিনি এক পক্ষকাল বিদেশে থাকবেন)।"
এখানে দুই-এ পক্ষ বলতে মাসের দুটি (মাসার্ধ)পক্ষকে বোঝানো হয়েছে। এই পক্ষ দুটি হল কৃষ্ণপক্ষ এবং শুক্লপক্ষ।
৩-তিন-এ নেত্র। নেত্র শব্দের অর্থ সংসদ বাংলা অভিধানে লেখা আছে চক্ষু,...
এখন তিন-এ নেত্র বলতে এখানে তিনটি চক্ষুর কথা বলা হয়েছে। সমস্যাটি এখানেই।গোটা বিশ্ব তন্ন তন্ন করে খোঁজ করলেও কোনো মানুষ তো দূরের কথা। গরু,ছাগল,হাঁস মুরগী, কোনো পশু পাখির মধ্যে কারোও তিনটি চোখ খুঁজে পাওয়া যায় না। এখানে আজগুবি, অবিশ্বাস্য, গল্পের গরু গাছে চড়ে মার্কা পৌরাণিক গল্প গুলো টেনে আনা হয়েছে। পৌরাণিক গালগল্পে আছে পৃথিবীর যতসব আষাঢ়ে গল্প গুলোর আঁতুরকুড়।পুরানেই পাওয়া যায় কারো জন্ম মাথা থেকে তো কারো জন্ম পা থেকে। কেউ উরু থেকে, কেউ আবার বাহু থেকে জন্ম গ্রহন করে। যতসব হাস্যকর অবৈজ্ঞানিক কান্ডকারখানা! এমন কি চোখের জল থেকে; কান থেকেও মানুষের জন্ম হওয়ার কথা পুরানে লেখা আছে। সেই পৌরাণিক কাহিনীতে শিবের তিনটি চোখের কথা বলা আছে। তাছাড়া কিছু পুরানে দুর্গার তিনটি চোখের কথা বলা হয়েছে।এটা নিয়েও নানা মুনির নানা মত। বির্তকিত বিষয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিশু মনে কেন এই অবৈজ্ঞানিক, বিতর্কিত বিষয় গুলো ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে? এর উদ্দেশ্যই বা কি তা পাঠকদের ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
৪- চার এ বেদ। আমরা জানি বৈদিক যুগে চারটি বেদ ছিল। এই চারটি বেদ হল...1) ঋক 2) সাম 3)যজু 4) অথর্ব। ঘুরে ফিরে সেই পৌরাণিক বিষয়। ছোট্ট ছোট্ট শিশুদের কি এগুলো জানা খুব প্রয়োজন? পাঠকগণ একটু ভেবে দেখবেন।
৫-পাঁচ এ পঞ্চবাণ। বাণ শব্দের অর্থ বাংলা অভিধানে লেখা আছে,ধনুক থেকে যে তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্র নিক্ষিপ্ত হয়, তির, শর।হিন্দু ধর্ম অনুসারে কামদেব অথবা মদন দেবের পাঁচটি বানের কথা বলা হয়ে থাকে। এই পাঁচটি বাণ হল...১) সম্মোহন 2)তাপন 3)শোষণ 4)উন্মাদন 5) স্তম্ভন। এখানেও সেই সহজ সরল শিশুর মনে ও বিশ্বাসে ধর্মীয় বিষয় পরিকল্পনা মাফিক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে শুরু হয় ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঠ। পৃথিবীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, এযাবৎ পৃথিবীতে লড়াই ঝগড়া করে যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তার সংখ্যাধিক্য মানুষের মৃত্যু হয়েছে ধর্মের কারনে। তাই ছোট্ট ছোট্ট সহজ সরল শিশুদের লেখাপড়ার হাতেখড়িতেই ধর্মীয় শিক্ষার পাঠ কেন?
৬- ছয়-এ ঋতু।আমরা যারা ভূগোল বই পড়েছি,তারা সময় জানি যে, গোটা বছরকে ছয়টি ঋতুতে ভাগ করা হয়েছে। এই ছয়টি ঋতু হল... 1)গ্রীষ্ম 2) বর্ষা 3) শরৎ 4) হেমন্ত 5) শীত 6) বসন্ত। এটা সত্যি।এটা মানতে কারো অসুবিধা নেই।
৭- সাত-এ সমুদ্র।বাংলা অভিধানে সমুদ্র শব্দের অর্থ দেওয়া আছে..সাগর,অর্ণব,দরিয়া,জলধি,বারিধি,অম্বুনিধি,প্রচেতা,জলেন্দ্র,জলেশ্বর,জলারণ্য,জলধর,নীলাম্বু,মকরালয়,মকরাকর,নীরধি,পয়োধি,জলাধিপ,বারিধর,বারিনিধি,বারীন্দ্র,বারীশ, প্রভৃতি।
এখানে সাত-এ সমুদ্র বলতে সাতটি সমুদ্র বা সাগরের কথা বলা হয়েছে। এই সাতটি সমুদ্র কোথায় অবস্থিত? বিভিন্ন দেশের ভূগোল বইয়ে খোঁজ করলে দেখা যাবে। মহাসাগর আছে, সাগর আছে ,উপসাগর আছে। কিন্তু কোনোটিই সংখ্যায় সাতটি নয়।এই পৃথিবীতে সমুদ্র বা সাগরের সংখ্যা মোট সাতটি নয়। আরো বেশি। উইকিপিডিয়া অনুসন্ধান করলে অনেক সাগর বা সমুদ্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেমন..
লোহিত সাগর। বঙ্গোপসাগর। আরব সাগর।তিমুর সাগর।জাপান সাগর।দক্ষিণ চীন সাগর। জাভা সাগর। মৃত সাগর।বেরিং সাগর। কৃষ্ণ সাগর।ভূমধ্যসাগর প্রভৃতি।কিন্তু সাত-এ সমুদ্র এগুলো নয়।
সাত-এ সমুদ্র হল,আমাদের দেশের পুরাণে বর্ণিত সাতটি সমুদ্রের নাম। এগুলি হল –1) লবণ 2) ইক্ষুরস 3)সুরা 4)ঘৃত 5)দধি 6)ক্ষীর 7)মিষ্টি
হ্যাঁ। এগুলিকেই সমুদ্র বলে মানতে হবে।শিখতে হবে। বাচ্চাদের শেখাতে হবে। আচ্ছা, শিশুদের সংখ্যামালা শেখার সাথে সাথে এই ভুল ধ্যান ধারণা গুলি কেন শিখতে হবে? সচেতন পাঠকদের এটাও ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি।
৮ - আটে অষ্টবসু। অষ্ট বসু মানে আট জন বসুর কথা বলা হয়েছে।মহাভারত অনুযায়ী দক্ষ রাজার কন্যা বসুর গর্ভজাত আটপুত্রকে বলা হয় অষ্টবসু। তাঁরা হলেন....1) ধর 2) ধ্রুব 3)সোম 4)অহ 5) অনিল 6)অনল 7)প্রত্যুষ 8)প্রভাস বা দ্যু। বলা হয় এই অষ্টবসুরাই ইন্দ্রের সহকারী, পরবর্তীতে তারা বিষ্ণুর সহকারী হন।
অষ্টবসুর এক বসু প্রভাস বা দ্যু যিনি মাতা গঙ্গা ও শান্তনুর পুত্র রূপে দেবব্রত নামে মর্ত্যে জন্মগ্ৰহণ করেন । পরে তার ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে ভীষ্ম নামে পরিচিত হন।
বৃহদারন্যক পুরাণ অনুযায়ী অষ্ট বসু হচ্ছে.... 1)পৃথিবী 2)অগ্নি 3)বায়ু 4)অন্তরীক্ষ 5) আদিত্য 6)চন্দ্রমা 7) নক্ষত্রাণি 8) দ্যু।
এখানেও সেই বির্তকিত বিষয়ের অবতারণা। একটার সাথে একটার কোনও মিল নেই!তবুও শিখতে হবে।পড়তে হবে। শিশুদের শেখাতে হবে! কিন্তু কেন??
৯- নয়-এ নবগ্রহ।নবগ্রহ মানে নয়টি গ্রহ।বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে নয়টিগ্রহের কথা বলা হয়েছে ।সেগুলি হল রবি, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু ও কেতু।
এখানে রবি অর্থাৎ সূর্যকে পুরানে গ্রহ বলা হয়েছে। কিন্তু রবি তো একটি নক্ষত্র। আমরা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে শিশুদের ভুল শিক্ষা দিচ্ছি। তাছাড়া রাহু ও কেতু নামে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব এই সৌরজগতে নেই। তবুও আমরা নয়টি গ্রহের মধ্যে রাহু কেতুকে রেখেছি। কারন পুরানে আছে। তাই রাহু, কেতু কে গ্রহ বলেই মানতে হবে।পড়তে হবে।শিখতে হবে।বাচ্চাদের শেখাতে হবে। কিন্তু কেন??
হিন্দু ধর্মের পুরাণ অনুসারে, "সমুদ্র মন্থনের সময় রাহু (স্বরভানু) নামক এক অসুর লুকিয়ে দিব্য অমৃতের কয়েক ফোঁটা পান করে। সূর্য্য ও চন্দ্রদেব তাকে চিনতে পেরে মোহিনী অবতাররূপী ভগবান বিষ্ণুকে জানায়। তৎক্ষণাৎ,অমৃত গলাধঃকরণের পূর্বেই বিষ্ণু আপন সুদর্শন চক্রের মাধ্যমে রাহুর ধড় থেকে মুন্ড ছিন্ন করে দেন। অমৃত পানের জন্য মুন্ডটি অমরত্ব লাভ করে এবং এভাবেই রাহু গ্রহটির উৎপত্তি হয়; (এই ভাবে কি কোনো গ্রহের জন্ম হতে পারে ?) বাকী মুন্ডহীন দেহটির নাম হয় কেতু। সূর্য্য ও চন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষের কারণে বছরের নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাহু এদেরকে গ্রাস (গ্রহণ) করে ফেলে। কিন্তু এই গ্রহণের পর সূর্য্য ও চন্দ্র রাহুর কাটা গ্রীবা থেকে আবার বেরিয়ে আসে।এই ভাবেই সূর্য গ্রহণ ও চন্দ্র গ্রহণ হয়।" যা একটি অবৈজ্ঞানিক মতবাদ।
আমরা ভূগোল বইয়ে পড়েছি সৌরমণ্ডলের কথা।সৌরমন্ডলে যে নয়টিগ্রহের নাম রয়েছে সেগুলি হল – বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি,শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। যদিও তার মধ্যে বর্তমানে প্লুটোকে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। প্লুটোকে বলা হয় বামন গ্রহ। ভেবে দেখুন, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির পরও আমরা কি পৌরাণিক গালগল্প গুলো মানব না বিজ্ঞান মানব ! বাচ্চাদের স্বার্থে এ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আপনার!
১০-দশ-এ দিক।দশটি দিকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই দশটি নাম হল পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত, উর্ধ এবং অধঃ।... এটা সত্যি। তাই এটা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
সময়ের সাথে বিজ্ঞানের সাথে তাল মিলিয়ে চলায় বুদ্ধিমানের কাজ। পরিশেষে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি রূপক কবিতার কয়েকটি লাইন নিম্নে উদ্ধৃতি করে এই লেখা শেষ করছি।
"যে নদী হারায়ে স্রোত চলিতে না পারে
সহস্র শৈবালদাম বাঁধে আসি তারে;
যে জাতি জীবনহারা অচল অসাড়
পদে পদে বাঁধে তারে জীর্ণ লোকাচার।"
ঋণ স্বীকার।
সংসদ বাংলা অভিধান।
বাংলা অভিধান।
কয়েকটি পুরাণ গ্রন্থ।
উইকিপিডিয়া।